নিউজ ডেস্ক:
জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশ যেভাবে রোহিঙ্গা বিষয়ক প্রস্তাব দিয়েছে, সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৩টি দেশ সেভাবেই তাতে মত দিয়ে পাস করেছে। এই প্রস্তাবে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন মৃদু প্রতিবাদ করলেও ভোটে তাদের সম্মতি জানায়। এই ঘটনাকে বাংলাদেশর কূটনীতির নতুন মোড় ও বিজয় হিসেবে দেখছে সরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন নিউজবাংলাকে বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে আমাদের মনমতো প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৩টি দেশের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে।
এর আগে গত ২০ জুন মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীকে জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার ও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে বাংলাদেশ। জুনের ওই প্রস্তাবের পক্ষে ১১৯টি ভোট পড়ে, বিপক্ষে ভোট দেয় শুধু বেলারুশ। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, লাওস, থাইল্যান্ড, রাশিয়াসহ ৩৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।
সেবারের প্রস্তাবে মিয়ানমারে গত ১ ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতি অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিকদের মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ওই প্রস্তাবে ভোট না দেয়া সম্পর্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানায়, প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো পদক্ষেপের সুপারিশ না থাকায় বাংলাদেশ অসন্তোষ জানায়।
বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এর আগে (২০ জুন) জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে প্রস্তাব পাস হয়, সেখানে আমরা ভোটদানে বিরত ছিলাম। কারণ সে সময় আমাদের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়নি। এবার আমাদের প্রস্তাবই সবাই পাস করেছে। আমাদের মনমতোই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।’
সোমবার জেনেভায় রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিত ও তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এবারই প্রথম কোনো প্রস্তাব বিনা ভোটে জাতিসংঘে গৃহীত হয়।
যে কারণে কূটনৈতিক বিজয়
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বরাবরের মতো রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে উত্থাপিত সর্বশেষ রেজুলেশনে আপত্তি করে চীন। কিন্তু অন্যবারের মতো এবার তারা ততোটা কঠোর হয়নি। আপস-আলোচনায় মৃদু আপত্তি বজায় রাখলেও প্রস্তাব পাস করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি বাংলাদেশের উন্নয়ন-বন্ধু চীন। ফলে চূড়ান্ত বিচারে সোমবার জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের দাবি, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল এবং লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকের বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় গ্রহণের পর এবারই প্রথম জাতিসংঘে রোহিঙ্গা বিষয়ক কোনো রেজুলেশন (প্রস্তাব) বিনা ভোটে, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলো। এটাকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বড় সাফল্য।
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একাধিক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, পাস হওয়া প্রস্তাবটি বাংলাদেশের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মাইলফলক হবে।
জেনেভার বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের প্রধান রাষ্ট্রদূত মোস্তাফিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ মিশনের প্রস্তাবে খোলাসা করেই বলা হয়েছে: অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় পাওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের দ্রুত রাখাইনে তাদের আদি নিবাসে প্রত্যাবাসনই চলমান সঙ্কটের টেকসই সমাধান।
মানবাধিকার পরিষদের চলমান অধিবেশনে বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়।
তিনি বলেন, শুরুতে মিয়ানমারের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রস্তাবটির বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও নিবিড় ও সুদীর্ঘ আপস-আলোচনায় শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
প্রস্তাবটির ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জেনেভায় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মানবিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমানা উম্মুক্ত করে দেন। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, গত চার বছরেও মিয়ানমারের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে অদ্যাবধি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।’
তিনি বলেন, কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের রোহিঙ্গাদের প্রতি মনোযোগ হারানো উচিত হবে না।
এদিকে, গত ১৬ জুন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘকে একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ প্রস্তুত করার অনুরোধ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। সেদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু লাউঞ্জে জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে এ অনুরোধ করেন তিনি।
এ সময় তিনি বলেন, ‘মানবিক বিবেচনায় আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তবে এই সঙ্কটের সমাধান নিহিত রয়েছে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের ওপর, যা গত চার বছরে সম্ভব হয়নি। আমরা চাই প্রত্যাবর্তন বিষয়ে জাতিসংঘ স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করুক।’
এর আগে ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, নির্বিচারে আটকসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৩৪ দেশ পক্ষে এবং ৯ দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ভোটদানে বিরত ছিল ২৮টি দেশ।
প্রস্তাবে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা প্রশমনে পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
এই প্রস্তাব যৌথভাবে উত্থাপন করেছিল ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা সংকট আবারো শুরুর পর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে মোট তিনটি প্রস্তাব পাস হলো।
মিয়ানমারকে চীনের কঠোরতার ইঙ্গিত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সর্বসম্মতিক্রমে এই রেজোল্যুশন পাসের তাৎপর্যটি সিম্বলিক। কার্যত ইউএনএইচসিআর নিজে কিছু করতে পারে না। কিছু করতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে করতে হবে। তবে সিম্বলিক ভ্যালু থাকবে। একটা প্রেসার তো পড়বে মিয়ানমারের ওপর। যেহেতু সর্বসম্মতিক্রমে একটি রেজুলেশন পাস হয়েছে।
‘কিন্তু রেজোল্যুশন পাস হয়েছে বলে এখন বসে থাকলে হবে না। আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। চীনের ভোট দেয়াকে আমি নতুনত্ব কিছু আমি মনে করি না। কারণ চীন আগে থেকেই রোহিঙ্গা ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠকও করেছিল, যা মহামারির কারণে থেমে গেছে। এখানে দেখার বিষয় চীনের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ফেরানোর বিষয়ে কী ভাবে, তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। আর পশ্চিমা দেশ কোনো বড় রকমের প্রেসার দিতে পারবে কিনা! সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কাজ এখনো বাকি আছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন আসবে যদি নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে কোনো রেজোল্যুশন আসে এবং তারা পক্ষে ভোট দেয় বা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে, যা তারা এবং রাশিয়া যেটা করে এসেছে। আমার মনে হয় চীন এ ধরনের ইঙ্গিত মিয়ানমারকে দিচ্ছে, যে এই সমস্যার সমাধান তোমাকে করতে হবে। না হলে এই প্রেসার ক্রমেই বাড়বে এবং বারবার তোমাকে রক্ষা করা যাবে না।’