এন রায় রাজা : চলতি বছরেই চালু হচ্ছে রেলের তিন মেগা প্রকল্প। দোহাজারী থেকে কক্সাবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত যেমন যুক্ত হবে রেল নেটওয়ার্কে, তেমনি পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল চলাচলও চলতি বছরের জুলাই মাস নাগাদ শুরু হবে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একইভাবে দেশের আরো একটি মেগা প্রকল্প খুলনা থেকে সুন্দরবনের বুক চিড়ে মোংলা পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণকাজ শেষের পথে। এটিও চলতি বছরের জুলাই মাসে উদ্বোধন করা হবে বলে রেল সূত্রে জানা গেছে।
রেলের এ তিনটি মেগা প্রকল্প চালু হলে দেশের রেলের মানচিত্র যেমন পাল্টে যাবে তেমনি ট্রান্সএশিয়ান রেলরুটে যুক্ত হবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। খুলে যাবে যাতায়াত ও বাণিজ্য সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত বলে মনে করছেন রেলসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চালু হলে সমুদ্রপিপাসুদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। বর্তমানে বাস বা বিমানে করে বহু কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করে যাওয়ার ঝক্কি, খরচ ও সময় সাশ্রয় হবে। বাড়বে পর্যটন সম্ভাবনাও। তেমনি পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল শুরু হলে ঢাকা থেকে সরাসরি মাওয়া, ভাঙ্গা হয়ে যশোর- খুলনা পর্যন্ত রেলপথে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে। আবার খুলনা থেকে রুপসা ব্রিজ পার হয়ে সুন্দরবনঘেঁষা নোনা পানির মোংলা অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার যেমন পরিবর্তন হবে, তেমনি মোংলা বন্দরের সঙ্গে রাজধানীর সহজ সংযোগ ঘটবে। বন্দরটি সংযুক্ত হবে খুলনা, যশোর, বেনাপোল হয়ে কলকাতা পর্যন্ত। যাতে ভ্রমণপিপাসু, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ভারত যাওয়া মানুষের যেমন সুবিধা হবে তেমনি ভারতের সঙ্গে বাড়বে ব্যবস্যা-বাণিজ্য।
দোহাজারী-রামু পর্যন্ত সব কাজই প্রায় শেষ। বাকি রামু থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ আশা করছি জুন- জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করতে পারবো। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ বলেও জানান তিনি। মুফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্পটির আওতায় ৯টি স্টেশনের মধ্যে ২টি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৭টির কাজ প্রায় শেষের দিকে। আর ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৬৫ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ, বাকি কাজ চলমান। এছাড়া বনের মধ্য দিয়ে হাতি ও বণ্যপ্রাণী চলাচলের জন্য আণ্ডারপাসের কাজ শেষ। এখানে প্রায় ১৫ কি.মি. রেলপথ বসানোর কাজ চলমান। কার্লভাট, ব্রিজের কাজও শেষের পথে। কক্সবাজারে নির্মাণাধীন আইকনিক স্টেশনের কাজও প্রায় ৮৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের বেশ কয়েক দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে বর্তমানে প্রকল্পটির মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা । দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি গত ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারবাসীর স্বপ্নের এই মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন।
এদিকে গত ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সময়ে সেতুর নিচ দিয়ে রেলপথ চালু হবার কথা থাকলেও নানা জটিলতায় কাজ পিছিয়ে যেতে যেতে বর্তমানে ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলবে বলে মনে করছে রেল মন্ত্রণালয়। ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে মাওয়া হয়ে পদ্মার ওপারে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার রেলপথের অগ্রগতি প্রায় ৭৫ শতাংশ, এর মধ্যে মাওয়া থেকে সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার রেলপথের অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ চালুর জন্য জোরকদমে কাজ চলছে। এর মধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ মোটামুটি শেষ, স্টেশনগুলোর কাজ চলছে। এদিকে সেতুর ওপর ৬ দশমিক ৭ কি.মি. রেল লাইন বসানো এবং ঢালাই শেষ হয়েছে। আগামী ৪ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাংকার ট্রেনে ভ্রমণ করে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন নির্মিত রেলপথসহ প্রকল্পের সার্বিক কাজ পরিদর্শন করবেন।
আবার ২০১০ সালে একনেকে পাস হওয়া খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেলপথটি আগামী জুলাই মাসে চালু হতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান। তিনি বলেন, চলতি মাস পর্যন্ত এ প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। গতকাল আরিফুজ্জামান ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন, খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৯৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। রুপসা রেল সেতুর কাজও শেষের পথে। আর চলতি বছরের জুনে না হলেও জুলাই মাসের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ২০১০ সালে একনেকে পাস হয়। এটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, করোনা মহামারি, জলা ভূমিতে মাটি ভরাটসহ নানা সমস্যার কারণে এটি শেষ করতে সময় লাগছে। নতুন নতুন এলাকায় নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। তবে সেগুলো মোকাবিলা করে আমরা কাজ যথাসম্ভব এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছি।
এসব বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করবো। যার মধ্যে অন্যতম- দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার রেল প্রকল্প। এটির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রকল্পটি শেষ হলে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যেতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা। এটি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত যাবে, এ বিষয়ে সেদেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। প্রকল্পটি শেষ হলে অতি অল্প সময়ে যাত্রীরা ঢাকার কমলাপুর থেকে চট্টগ্রাম- দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাবেন। এতে একদিকে যেমন ভ্রমণ পিপাসুদের আর্থিক ও সময়ের সাশ্রয় হবে তেমনি আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটবে সংশ্লিষ্ট এলাকার। তিনি জানান, কক্সবাজারে একটি আইকনিক স্টেশন তৈরি হচ্ছে। এখানে লকারে জিনিষপত্র রেখে সমুদ্রসৈকতে নিরাপদে ঘুরে বেড়ানো যাবে। আবার রাতের ট্রেনে রাজধানীতে ফিরতে পারবেন। এছাড়া এ বছরের জুলাই নাগাদ পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের আওতাধীন ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে ভাংগা পর্যন্ত রেলপথের উদ্বোধন করার জন্য কাজ চলছে। রাজধানী থেকে সরাসরি পদ্মা সেতু হয়ে ভাংগা পর্যন্ত যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারবে। তিনটি নতুন জেলা রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে। এর পরে ২০২৪ সালে আমরা যশোর পর্যন্ত প্রকল্পটি শেষ করব। এটি হলে রাজধানীর সঙ্গে যশোর, খুলনা হয়ে মোংলা বন্দরও সরাসরি রেল নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হবে। এর ফলে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।
আর খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত রেলপথটিও চলতি বছরের জুলাই মাস নাগাদ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী। তিনি মনে করেন, মোংলা বন্দরের সঙ্গে রেলপথটি সংযুক্ত হলে সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের যাতয়াতের যেমন সুবিধা হবে তেমনি মোংলা থেকে সরাসরি কলকাতা বা ভারতের বাণিজ্য ও পর্যটন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। পাল্টে যাবে রেলের মানচিত্র। ট্রান্সএশিয়ান রেলরুটে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।