নিউজ ডেস্ক:
অর্থনীতির অস্বস্তির মাঝে দেশে এ বছর রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। রেমিটেন্সে ও রপ্তানি আয়ে নিম্নগতির ফলে রিজার্ভের পতন, রাজস্ব আয়ে নিম্নহারে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় দেশে চার কোটি ৭৭ লাখ টনের রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন সরকারকে বেশ স্বস্তির মধ্যে রেখেছে। এরমধ্যে শুধু চালই উৎপাদিত হয়েছে চার কোটি টনেরও বেশি। ফলে সরকারকে চাল আমদানি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। বাংলাদেশ শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেনি, সব ফসল উৎপাদনেই আশাতীত সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সবচয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- এ সময়ে ফসলের বহুমুখীকরণ হয়েছে চমৎকারভাবে। কৃষক এখন আর ধান-পাট চাষ নিয়েই ব্যস্ত থাকছে না, লাভজনক ফসল হিসেবে নানা ধরনের সবজি, ফল (দেশী-বিদেশী) উৎপাদনে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ফলে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে কৃষি পণ্যের রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে।
এই রেকর্ড খাদ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়েই আজ সোমবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব খাদ্য দিবস পালিত হচ্ছে। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘পানিই জীবন, পানিই খাদ্য/ কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে র্যালি, সভা-সেমিনার ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দেশে দিবসটি পালন করা হবে। এ উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। বেসরকারি সংস্থা রাইট টু ফুড জমায়েত, আলোচনা ও র্যালির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।
এবারের খাদ্য দিবসে সরকার তার বিগত ১৫ বছরের কৃষির অগ্রগতির মূল্যায়ন করছে। ১৫ বছরের অগ্রগতি তুলে ধরে এই দিবসে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এই বিশেষ সংখ্যায় একনজরে কৃষির সাতটি সাফল্য তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সাতটি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, জাম জাতীয় ফল উৎপাদনে চতুর্থ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থানে রয়েছে।
বিগত দেড় দশকে চাল গম ও ভুট্টা মিলিয়ে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে এক কোটি ৪৫ লাখ টন। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৭৭ লাভ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। এ সময়ে চাল উৎপাদন বেড়েছে ৮৮ লাখ টন। ২০০৮-০৯ সালে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন, ২০২২-২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি এক লাখ ৭৬ হাজার টনে। এ সময়ে আশাতীত ফলন বেড়েছে ভুট্টার। এ ফসলটির উৎপাদন বেড়েছে ৫৭ লাখ টন। ২০০৮-০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন ছিল সাত লাখ ৩০ হাজার টন, ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ লাখ ২২ হাজার টন।
এটা সম্ভব হয়েছে উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও আবাদ বৃদ্ধির কারণে। শিল্পায়ন ও আবাসনের কারণে দেশে কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও স্বল্প জমিতে অধিক পরিমাণ ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল জাতের আবাদ বৃদ্ধির কারণে। বর্তমানে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে প্রতি বিঘা জমিতে ২৫ মণের অধিক ধান আবাদ সম্ভব হচ্ছে।
কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০০৯, বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-২০২৩ তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে আলু উৎপাদন দ্বিগুণ, ডাল চার গুণ এবং আর সবজি উৎপাদন বেড়েছে এ কোটি ৯৬ লাখ টন। মূলত সবজিই কৃষিকে বেশি লাভজনক করে তুলেছে। পাল্টে দিয়েছে কৃষকের জীবনধারা। ২০০৮-০৯ সালে যেখানে সবজির উৎপাদন ছিল ২৯ লাখ ৯ হাজার টন, ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২৫ লাখ ৪১ হাজার টনে। অনাবৃষ্টি এবং তাপপ্রবাহের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে এ বছর বোরোতেও বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এ বছর ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে বোরো জমির ধান পুরোপুরি সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছর বোরো উৎপাদনও সরকারের পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি ১৫ লাখ টন। ইতোমধ্যে চাল আকারে বোরো উৎপাদন দুই কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতিতে মানুষ বর্তমানে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বোরোর এমন ফলন দেশে খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা বেশ কিছুটা কমাবে। সার, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কৃষকরা এমন ফলন নিশ্চিত করতে পেরেছেন। করোনা মহামারির সময় বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও সরবরাহ চেইনে বিশৃঙ্খলতার সময়ও যেমন দেশের কৃষকরা ভালো ফলন উপহার দিয়েছিলেন, এবার আবারও সেটাই করে দেখালেন তারা।
কৃষিবিদরা বলছেন, তাপপ্রবাহের কারণে বোরো ধান সংগ্রহে সুবিধা হয়েছে, প্রচণ্ড তাপে ধান মাঠেই শুকিয়ে গেছে। অনুকূল আবহাওয়া পরিস্থিতির পাশাপাশি কীট-পতঙ্গেরও বড় কোনো আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। বরং বোরোর ফলন ভালো হওয়ায় দেশ স্বস্তির অবস্থানে আছে।
বর্তমান দৃশ্যপট গত জুনের চেয়ে পুরোদস্তুর ভিন্ন। সে সময় মহামারির বিদায়ী রেশ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা সরকারকে বাড়তি খাদ্য মজুতের চাপে ফেলেছিল। তখন বাংলাদেশের চাল আমদানির অন্যতম উৎস ভারতও চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু এবার সেই কৃষকরাই আবারও দেশকে উদ্ধারে এগিয়ে এসেছেন। একের পর এক বাম্পার ফলন ফলিয়ে খাদ্য আমদানির মতো পরিস্থিতি থেকে দেশকে স্বস্তিতে রেখেছেন।