মঙ্গলবার , এপ্রিল ২৩ ২০২৪
নীড় পাতা / সাহিত্য ও সংস্কৃতি / গল্পকথা / রুদ্র অয়ন এর ছোটগল্প “জয় পরাজয়”

রুদ্র অয়ন এর ছোটগল্প “জয় পরাজয়”

জয় পরাজয়

নরম-কোমল স্বভাবের মানুষ আকরাম হোসেন। সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন। তার মতো সরল আর ভালো মানুষ খুব কমই আছে দুনিয়ায়।

চয়নের চোখে ওর বাবা একটা শ্রেষ্ঠ মানুষ। অবশ্য সব সুশিক্ষিত সন্তানের চোখে তার বাবাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, ভালো মানুষ! বাবার মতো এ রকম সরল মানুষ একালে একদম অচল। কোনোদিন তিনি পা বাড়াননি কবিতার কঠিন প্রান্তরে। হেঁটেছেন গদ্যের সহজ-সরল মেঠো পথ ধরে। কিন্তু বাবা তবু অচল মুদ্রার মতো টিকে আছেন বর্তমান সমাজে। পাঁচ বছর ধরে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। তার পেনশনের ফাইলটা আটকে আছে সাড়ে চার বছর হলো। কবে সারাজীবনের কষ্টের টাকার চেক হাতে আসবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

সাত সকালে মা রান্না ঘরটা গ্যাসের চুলার আগুনের চেয়েও গরম করে ফেলেছেন। কারণ আর কিছুই না, সংসারের অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি এখন পরাজিত একজন মানুষ। পেনশনের টাকাটা না পেলে আর একটা দিনও ভালো থাকার উপায় নেই। দুদিন আগে পাশের বাসার প্রতিবেশী এক ভদ্রমহিলা বলে গেছেন মাকে, ‘আপা, ঘুষ দিলেই যখন তখন চেক পাওয়া যায়। ঘুষ এতদিন দেন নাই, তাই আপনাদের ফাইল মর্গে বেওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে আছে।’ আর এই নিয়ে সকালেই বাবার সঙ্গে মায়ের খুব লেগে গেছে।

মা চড়া গলায় বললো, ‘তুমি পনেরো দিনের ভেতর ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তুলে আমার হাতে দেবে।’
: ‘তুমি কি পাগল হয়েছো চয়নের মা! আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সারা জীবন ন্যায়ের পক্ষে থেকেছি। এখন শেষ জীবনে ঘুষ দিয়ে আমার ন্যায্য পাওনা টাকা তুলবো?’
– ‘তুমি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ কী? কোনো সার্টিফিকেট আছে?’
: ‘কি, ঘোড়ার ডিম ; যা তা বলছো। সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে প্রমাণ করতে হবে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা? আমি কি সার্টিফিকেটের আশায় যুদ্ধে গিয়েছিলাম?’
– ‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। আজকাল এই ঘোড়ার ডিম না থাকলে যতই চেঁচাও তুমি মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা! তোমার কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।’
: ‘চয়নের মা, আমি তোমার কষ্টটা বুঝি। আসলে আমার ভাগ্যটাই খারাপ। পেনশনের সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য এভাবে ফকিরের মতো অপেক্ষা করতে হবে, তা আমি আগে বুঝিনি।’
– ‘আর তোমার বুঝতে হবে না। চয়ন সব বুঝে এসেছে। এখন যা করার সে-ই করবে। আগামী এক মাসের ভেতর তুমি পেনশনের টাকার চেক হাতে পাবে।’
: ‘কী বলছো তুমি! আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। আমি ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তুলবো না। যেদিন হবে সেদিন হবে, এটাই আমার ফাইনাল কথা।’

চয়ন বিছানা ছেড়ে ওঠে ড্রয়িং রুমে সোফার ওপর হেলান দিয়ে বসে। চয়নকে দেখেই দুজনের উত্তপ্ত সংলাপ বিনিময় হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো যেন টিভি নাটকের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতি!
গত সপ্তাহে চয়ন নীলক্ষেতের বেনবেইজ অফিসে, যেখানে বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের ফাইল জমা থাকে, সেখানে গিয়েছিলো। সেই অফিসের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সঙ্গে চয়নের বন্ধু অভি’র পরিচয়ের সূত্র ধরে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলেছে চয়ন।
ঢাকায় একটা পাবলিক কোম্পানিতে কম্পিউটার আইটি স্পেশালিষ্ট হিসেবে জব করে চয়ন। আজ কয়দিন হলো দেশের বাড়িতে এসেছে সে।

বাবার পেনশনের টাকার ব্যাপারে এতোদিন সে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। অবশেষ মায়ের কথায় এবার চেকের ব্যাপারে উদ্যোগি হয়েছে।
এতোটাদিন বাবা পেনশনের টাকার ব্যাপারে ঘুরেছেন আর এক বুক হতাশা নিয়ে, অসুস্থ শরীর নিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে ঘরে ফিরেছেন। আহা, কী অভিশপ্ত এই দেশের সৎভাবে বিচরণ করা সরল সহজ মানুষদের জীবন! স্বাধিনতার সুফল কি শুধুই ক্ষমতার মসনদে বসা মানুষগুলোর আর উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত মানুষদের জন্যে?

কয়েক দিন পর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সঙ্গে আবার দেখা করতে যায় চয়ন। তিনি প্রথমে চয়নের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হাতের ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন। মাঝবয়সী, তৈলাক্ত টাকের একজন গন্ডার মার্কা চেহারার পান খাওয়া মানুষ।
চয়নের কাছে মনে হলো, হারাম উপার্জন বা ঘুষ খেয়ে খেয়ে তার চেহারায় ছাপ পড়ে গেছে। অথচ, তার রুমের বাইরে দেয়ালে বড় করে লেখা আছে, ‘পেনশনের টাকার জন্য কারো সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করিবেন না।’

আরেক জায়গায় লেখা, ‘ইহা সকল প্রকার দুর্নীতিমুক্ত ভবন।’
এমনটাই হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের রাষ্ট্র তথা দেশের চিত্র। গোড়াতেই তো গলদ। বর্তমানে সরকারের পক্ষ্য থেকে দুর্ণীতি বন্ধের কথা বলা হয় জোরেশোরে, কিন্তু খোদ সরকার ও প্রশাসনের-ই ভেতরে বাইরে দুর্ণীতি আর ঘুষে নিমজ্জিত!

বাংলাদেশে সরকারি প্রায় প্রত্যেকটা সেবাতেই সাধারণ জনতার ভোগান্তি’র শেষ নেই! আইন/পুলিশ সেবা, চিকিৎসা সেবা বা শিক্ষা… সকল ক্ষেত্রেই অনিয়ম আর দুর্ণীতির কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে!
ক্ষমতা নিয়ে কামড়া কামড়ি চলে, কিন্তু দেশের কথা দশের কথা নেতারা ভাবেন না! বানরেরা যেন আজ ভাগ করে খায় বিড়ালের পিঠা। বড় বড় প্রকল্প হাজির হয়, আর দিনে দিনে শুধু তার খরচ বাড়ে! অন্যপ্রান্তে নেতা,মন্ত্রীদের টাকার সৌধ তৈরি হয় অন্য দেশে।
চয়নের খুব কষ্ট হচ্ছিল এই কারণে, এই দেশের জন্য একদিন বাবা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিলেন!

হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা চেয়ার থেকে ওঠে নিজ হাতে ভেতর থেকে দরোজা লাগিয়ে দিলেন। তারপর চয়নের দিকে শয়তানের মতো একটা দাঁতাল হাসি দিয়ে কথা শুরু করলেন।
‘কী নাম আপনার বাবার? কতদিন হলো ফাইল জমা দিয়েছে?’
: জ্বি, আকরাম হোসেন। প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে।
– ‘ফাইল জমা দেওয়ার সিরিয়াল নম্বরটা এনেছেন?’
: জ্বি, এনেছি।
– ‘আচ্ছা, দিন সেটা আমার কাছে। সরাসরিই বলি, যদি বৈধ পথে সিরিয়াল অনুসারে টাকা পেতে চান,

তাহলে আরো বছরখানেক লাগবে। পাল্টা কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। আর যদি কিছু টাকা পয়সা খরচ করেন, তাহলে আমি ১৫ দিনের ভেতর চেক রেডি করে দিয়ে দেবো। আপনার বাবা নিজে এসে চেক আগে বুঝে নেবে তারপর আমার পাওনাটা দেবে। এখন কোনো অগ্রিম টাকা দিতে হবে না। কাজের পরে আমি টাকা নিই। রাজি আছেন?’
: জ্বি, রাজি। কত টাকা দিতে হবে, এই বারো লাখ টাকার চেকের জন্য?
‘বেশি না, হাজার চল্লিশ টাকা।’
: অন্য কোনো ঝামেলা হবে না তো? মানে, ডুপ্লিকেট চেক ইস্যু হবে না তো?
– ‘হাহাহা, তাইলে কি মিয়া চাকরি থাকবে? আমি কোনো নয়-ছয়ের ভেতর নাই। সলিড কাজ করি।’

শুরুতে এই রাজ্জাক সাহেবের প্রতি যে নেগেটিভ ধারণাটা ছিল, তা ধীরে ধীরে ইউটার্ন নিয়ে পজিটিভ হতে লাগল। মনে মনে চয়ন ভাবে, যে কাজ পাঁচ বছরে করতে পারলেন না সনদবিহীন মুক্তিযোদ্ধা বাবা, সেই কাজ আজ আধঘণ্টায় মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার এক অন্যায় শর্তের কাছে আটকা পড়ে হয়ে গেলো।
চলে আসার সময় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাহেব তার মোবাইল নম্বর দিয়ে বললেন :
‘এটা আমার পারসোনাল নম্বার। কল দেবেন যদি কোনো দরকার মনে করেন। আর কাজ হয়ে গেলে আমিই আপনার নম্বরে কল দিয়ে জানাবো। চিন্তা কইরেন না। আল্লাহ ভরসা। যে কাজের যে উপায়।’ এই বলে হাসতে লাগলেন চয়নের দিকে তাকিয়ে।
তেরো দিনের মাথায় দুপুর বেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাহেব চয়নকে ফোন দিলেন ।

‘হ্যালো, চয়ন ভাই?’
: ‘জ্বী ভাই, কেমন আছেন?’
– ‘আছি ভাই, আপনার কাজ হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে আপনার বাবা সহ আজকেও আসতে পারেন কিংবা দুদিন পরও আসতে পারেন।’
: বলেন কী ভাই! এত তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে গেল! আপনি তো ম্যাজিকম্যান!
– ‘আরে ভাই, টাকায় কাজ করছে। আমি করি নাই। আমি হলাম উছিলা মাত্র। আচ্ছা, আপনার দেশের বাড়ি যেন কোথায়?’
: নাটোর।   
– ‘শহরে নাকি গ্রামে?’
: ‘শহরেই।’
– ‘ও, ভালো। শুনুন ভাই, আপনারদের খুব নিকটবর্তী ডিষ্ট্রিক্ট চাঁপাই শিবগঞ্জ-এর আদি মিষ্টি চমচম নিয়ে দুদিন পরেই আসেন। চেক আমার পকেটেই আছে। টেনশনের কোনো কারণ নেই। অনেক দিন চাঁপাইয়ের বিখ্যাত আদি চমচম মিষ্টি খাই না। আহ্।’
: ‘ঠিক আছে,নিয়ে যাবো।’

হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সাহেবের সঙ্গে কথা শেষ করে চয়ন বাবার ঘরে গেলো। তিনি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তসবি জপছেন। মা-ও চয়নের সঙ্গে সঙ্গে এলেন। পুরো ঘটনা চয়ন বাবাকে খুলে বললো। সব শুনে তিনি চোখ বন্ধ করেই নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে, কবে যেতে হবে আমাকে বলিস। আমি যাব।’

বাবার এরকম নীরব প্রতিক্রিয়ায় চয়নের ভেতর কেমন জানি একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। মনে হলো, যে মানুষটা বুক চিতিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, পাকিস্তানিদের হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, সেই মানুষটা স্বাধীন দেশে নিজের ন্যায্য পাওনা পেতে ঘুষনীতি ও অনিয়ম-অন্যায়ের কাছে কত নির্মমভাবে পরাজিত হয়ে গেলেন!

আরও দেখুন

বড়াইগ্রামে বাংলা নববর্ষ উদযাপন 

নিজস্ব প্রতিবেদক: নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা প্রশাসনের উদ্যেগে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১  উদযাপন করা হয়েছে। পরে সকাল …