অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আমদানির জন্য তিন হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এটা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কম। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬৩৯ কোটি ডলার। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে খোলা হয় যথাক্রমে ৬৬২ কোটি ও ৬৫১ কোটি ডলারের এলসি। অক্টোবরে তা এক ধাক্কায় ৪৭৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। নভেম্বরে সেটা আরও কমে ৪০২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ডিসেম্বরে সেটা সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি ডলার।
ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়ির ফল মিলছে এখন। আমদানি ব্যয়ের লাগাম বেশ ভালোভাবেই টেনে ধরা গেছে। কমতে শুরু করেছে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক পণ্য আমদানির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর একই সময়ে নিষ্পত্তি কমেছে এক দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বর্তমান অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমদানি কমাকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘মঙ্গল’ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে এটার খুব দরকার ছিল। আমদানি কমলে ডলারের বাজারও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
যদিও সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমে ৩২ বিলিয়ন (৩ হাজার ২০০ কোটি) ঘরে নেমে এসেছে। রোববার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন (৩ হাজার ২৫৭ কোটি) ডলার। এর আগে বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ছিল ৩৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার আকুর নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১১২ কোটি (১.১২ বিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করা হয়। রোববার তা সমন্বয়ের পর ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এলসি কমলেও আগের দায় পরিশোধের চাপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমেনি।
এদিকে মঙ্গলবার আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ সময় পণ্য আমদানিতে ডলারের সহায়তা চান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি)। জবাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন গভর্নর।
ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, এলসি খোলার পাশাপাশি এবার নিষ্পত্তির হারও কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্যের আমদানি অনেক কমেছে। এতে আমদানির খরচ কমে আসায় বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে খুব শিগগিরই স্থিতিশীলতা আসবে।
এলসি খোলার হার
অর্থবছরের জুলাই–ডিসেম্বর সময়ে আমদানির জন্য তিন হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ কম।
অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৬৩৯ কোটি ডলার। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে খোলা হয় যথাক্রমে ৬৬২ কোটি ও ৬৫১ কোটি ডলারের এলসি। অক্টোবরে তা এক ধাক্কায় ৪৭৪ কোটি ডলারে নেমে আসে।
নভেম্বরে সেটা আরও কমে ৪০২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ডিসেম্বরে সেটা সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি ডলার।
নিষ্পত্তি কমেছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে তিন হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল তিন হাজার ৮৩৮ কোটি ডলার। সেই হিসাবে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে এক দশমিক ৫৬ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে কোনো পণ্য আমদানি হয় না। বেশিরভাগ এলসির দেনা পরিশোধ হয় পণ্য দেশে আসার পর। অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশিরভাগ আমদানি হচ্ছে বায়ার্স ক্রেডিট বা ডেফার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে। এ উপায়ে পণ্য পাওয়ার পর নির্ধারিত সময় শেষে এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ
আমদানি কমাতে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৭ এপ্রিল। ওই দিন এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর ১০ মে বিলাসপণ্য আমদানি কমাতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করে আরেকটি সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সার্কুলারে বলা হয়, সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।
সর্বশেষ গত ৫ জুলাই আরও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ধরনের মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকসসামগ্রী, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিকসামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে এখন থেকে ব্যাংক থেকে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা পাবেন না আমদানিকারকরা। এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে, এর আগে যা ছিল ৭৫ শতাংশ।
রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যয়সংকোচনের পথ বেছে নেয় সরকার। অতি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কর্তাদেরও বিদেশ সফর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ আমদানিনির্ভর প্রকল্পের বাস্তবায়ন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।