নিজস্ব প্রতিবেদক গুরুদাসপুর ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,রাত তখন ১টা ২০ মিনিট। চারিদিকে ঘন অন্ধকার, নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে
শোনা যাচ্ছে মাটি কাটার শব্দ। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে
উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিন ফসলি কৃষি জমিতে চলছে অবৈধ
পুকুর খনন। আশেপাশের মানুষ নিশ্চুপ অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও
নেই।
কিন্তু একজন নারী, যিনি ভয় পান না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং
কৃষি জমি রক্ষায় গভীর রাতে ছুঁটে গেলেন তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
(ইউএনও) ফাহমিদা আফরোজ। মাত্র দুইজন আনসার ও দুইজন পুলিশ সদস্য নিয়ে
তিনি হাজির হলেন সেই মাঠে। পুকুর খননকারীদের হাতেনাতে ধরলেন। প্রভাবশালী
মাটি ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলে প্রশাসন রাতে আসবে না, তাও আবার নারী ইউএনও।
কিন্তু ভ‚ল ভাঙল তাদের। ইউএনও’র কড়া নির্দেশে খননকাজ বন্ধ করা হলো, জড়িতদের
বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হলো। এ যেন অপরাধীদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের রাত।
গত দুই মাসে কৃষি জমিতে পুকুর খনন শুরু করার পূর্বেই প্রায় ১২ জন মাটি
ব্যবসায়ীকে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত ৫ বছরে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা
অমান্য করে পুকুর খনন ও মাটি বিক্রির ফলে তিন ফসলি কৃষি জমি কমেছে ১৫১০
হেক্টর। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর এই মৌসুমেও মাটি ব্যবসায়ীরা শুরু করেছিলেন
পুকুর খননের কাজ। প্রশাসনের কঠোর ভূমিকার কারণে চলতি মৌসুমে
গুরুদাসপুর উপজেলায় প্রায় ৪০০ বিঘা কৃষিজমি পুকুর খননের হাত থেকে রক্ষা
পেয়েছে। প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ না থাকলে এই মৌসুমে প্রায় ৪০০ বিঘা
কৃষি জমিতে পুকুর খনন হয়ে যেতো। পুকুর খনন না হওয়ায় কৃষকদের মাঝে
স্বস্তির বাতাস বইছে। তারা মনে করছেন, এভাবে যদি প্রশাসন কঠোর অবস্থান
বজায় রাখে, তবে কৃষিজমি রক্ষা পাবে এবং খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ৩৬তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ফাহমিদা
আফরোজ ২০২৫ সালের ৫ জানুয়ারী গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
(ইউএনও) হিসাবে যোগদান করেন। শুধু কঠোর অবস্থানই নয়,মানবিক গুণাবলির
জন্যও তিনি উপজেলাজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন। একাধারে তিনি গুরুদাসপুর
উপজেলার ইউএনও, পৌরসভার প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের প্রশাসক এবং ৫০টি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও উপজেলার
১৮টি সরকারি অফিসের প্রধান হিসাবেও বিভিন্ন সময় জটিল সমস্যা সমাধান
করতে হচ্ছে তাকে। একাধিক দায়িত্ব কাঁধের ওপর নিয়েও দক্ষতার সহিত উপজেলা
প্রশাসন পরিচালনা করে যাচ্ছেন তিনি।
উপজেলার বিয়াঘাট অঞ্চলের আব্দুর রাজ্জাক, আসকান আলী, আব্দুল খালেক, আজাদুল
ইসলামসহ কৃষক ও সাধারণ মানুষ ইউনেও’র এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন,‘
ইউএনও’র কঠোর অবস্থানের জন্য কৃষকরা তাদের কৃষি জমি রক্ষা করতে পেরেছেন।
প্রশাসনের এমন ভ‚মিকা তাদের কৃষির জন্য আশীর্বাদ।’ এদিকে কৃষিজমি রক্ষায়
প্রশাসনের এমন কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকলে গুরুদাসপুরসহ দেশের অন্যান্য
অঞ্চলেও কৃষি অবকাঠামো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গুরুদাসপুর পৌরসভার সমাজসেবক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল
জানান,‘ফাহমিদা আফরোজ কেবল কঠোর নন,তিনি মানবিকতার প্রতীকও। তিনি
উপজেলার অসহায়,দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের জন্য সবসময় পাশে দাঁড়ান। দরিদ্র
কৃষকদের সরকারি সুবিধা পেতে সহায়তা করেন। অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের
সুযোগ সৃষ্টির করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। একজন নারী কর্মকর্তা
হিসাবে ফাহমিদা আফরোজ সবময় নারীদের প্রতি সহনশীল ও উদার। তিনি
উপজেলায় নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশ তৈরি করতে নিরলস
কাজ করে যাচ্ছেন।’
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ হারুনর রশিদ বলেন,“গুরুদাসপুর
উপজেলার তিন ফসলি কৃষিজমি আমাদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একটিমাত্র মৌসুমের জন্য পুকুর খনন করে মাছ চাষ করলেই দীর্ঘমেয়াদে কৃষি
উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। ফসলি জমি একবার নষ্ট হয়ে গেলে সেটি
আর আগের অবস্থায় ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়াও গুরুদাসপুর থেকে যে
পরিমাণ মাছের উৎপাদন হয় তা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও বাহিরে রপ্তানি করা
হচ্ছে।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা আফরোজ বলেন,“আমি
প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য
কাজ করে যাচ্ছি। গুরুদাসপুরে তিন ফসলি কৃষিজমি নষ্ঠ হয়ে গেলে শুধু
কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে না,বরং আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে।
তাই আমি কোন ভাবেই অবৈধ পুকুর খনন মেনে নেব না। অনেকেই প্রভাব
খাটানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই কেউ আইনের উর্দ্বে
নন। অবৈধভাবে কৃষিজমি ধ্বংস করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাত-দিন যখনই হোক,আমি মাঠে থাকব,প্রশাসন মাঠে থাকবে।”
ইউএনও আরো বলেন,“আমি শুধু একজন কর্মকর্তা নই, আমি এই উপজেলার
একজন মানুষ। এখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হতে চাই। বিশেষ করে দরিদ্র,
অসহায় ও নারীদের কল্যাণে আমার দরজা সবসময় খোলা। সবাইকে অনুরোধ করব,
অন্যায় দেখলে চুপ না থেকে প্রশাসনকে জানান। আইন নিজের হাতে নেবেন না,
প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। আমার একটাই লক্ষ্য একটি সুন্দর, ন্যায়ভিত্তিক
এবং কৃষি সমৃদ্ধ গুরুদাসপুর গড়ে তোলা, যেখানে কৃষক তার জমি নিয়ে
শঙ্কিত থাকবে না, যেখানে অসহায়রা প্রশাসনের দ্বারে এলে ফিরে যাবে না