নিজস্ব প্রতিবেদক,বাগাতিপাড়া (নাটোর):এ যেন চেঙ্গিজ খানের যুদ্ধের কৌশল, প্রতিপক্ষ হাজার শক্তিশালী হলেও তার অস্ত্র ধ্বংস করে যুদ্ধে জয় লাভ। তেমনই ঘটনা ঘটছে নাটোরে। জেলার সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে মজা পুকুর, জলাশয় ও নিচু জমির বলে খাজনা দিয়ে অনুমোদন নিচ্ছেন পুকুর কাটার। অপরদিকে এই অনুমোদনের জোরেই প্রতিদিন জেলাজুড়ে তিন ফসলি জমিতে কাটা হচ্ছে শত শত পুকুর। এসব পুকুর কাটার মাটির বেশির ভাগই যাচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটায়। গড়ে প্রতিটি পুকুর কাটার জন্য সরকারি কোষাগারে ১০ হাজার টাকা খাজনা জমা হলেও পুকুর মালিককে ঘুস কমপক্ষে চার লাখ টাকা। জমি মালিকরা নিজেরা নিরব থেকে মাটি কাটার ভেকু মালিকদের সঙ্গে করা চুক্তির মধ্যেই নেওয়া হচ্ছে প্রশাসনের অনুমতি। লেনদেন হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এমন একটি অডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে। ঘুস লেনদেন প্রক্রিয়ার অবলীলায় স্বীকার করা গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের অফিস সহকারী আমজাদ হোসেনের একটি অডিও বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এছাড়াও অনুমতি না নিয়ে রাতের অন্ধকারে জেলার উপজেলাগুলোতে চলছে পুকুর কাটার হিড়িক। প্রশাসন দেখেও দেখছে না কিছু!
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে দেশের শস্য ভান্ডারখ্যাত নাটোর জেলায় গত ১০ বছরে আবাদি জমি কমেছে ৮ হাজার ৬৮৫ হেক্টর। আর অপরিকল্পিত পুকুরের কারণে জলাবদ্ধতায় ডুবে গেছে আরও ৬০২ হেক্টর জমি। এখনই কঠোর আইন তৈরি ও তার বাস্তবায়ন করা না হলে আগামীতে আবাদযোগ্য জমি শূন্যের কোটায় যাওয়ার আশঙ্কা করছে সচেতন মহল। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার ডাকরামাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল বাছেদ তার আবাদি জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষের জন্য আবেদন করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিশাত আনজুম অনন্যার কাছে। জামনগর ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. বদরুজ্জামান ওই জমির বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেন উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি)। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি রেকর্ডে ধানী শ্রেণির জমি, কিন্তু বাস্তবে জলাবদ্ধ। ওই জমি পুকুর হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এমন তথ্য প্রতিবেদনে দেওয়া হয়নি। তারপরও পুকুর হিসেবে আব্দুল বাছেদের কাছ থেকে ৯ বছরের খাজনা নিয়েছেন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান। পরে বাছেদ আলী সংস্কারের নামে আবাদি জমিটিতে পুকুর খনন করছেন। একই ইউনিয়নের একডালা গ্রামের অপর কৃষক মো. সজল হোসেন পুকুর সংস্কারের আবেদন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে। সেখানেও ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদনে তিনি মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, জমিটি আবাদি শ্রেণির। তবে নিচু জলাশয়ের মতো অবস্থানের কারণে এতে ঘাস জমে আছে এবং আবাদের অনুপযোগী। অন্যদিকে জেলার সদর, নলডাঙ্গা, লালপুর, বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুরসহ প্রতিটি উপজেলায় অসংখ্য জায়গায় প্রকাশ্যে চলছে পুকুর খননের কাজ। সরজমিনে দেখা যায়, বাগাতিপাড়ার বাঁশবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমানের আবাদি জমিতে চলছে পুকুর খনন। সরকারি রেকর্ডে এটি আবাদি শ্রেণির জমি। কৃষক মতিউর রহমান জানান, ‘আমি আর আমার ভাই পুকুর খননের জন্য ভূমি অফিসে যোগাযোগ করি। ভূমি অফিসের কর্মকর্তার কথা মতো আমরা পুকুরের খাজনা দিয়ে পুকুর কাটছি। পুকুর হিসেবে ব্যবহার শুরুর আগেই কীভাবে পুকুরের খাজনা আদায় করেছেন জানতে চাইলে জামনগর ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা বদরুজ্জামান বলেছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে আমি খাজনা নিয়েছি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাগাতিপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, সরকারের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য কয়েকটি মজা পুকুর, নিচু ও পরিত্যক্ত অনাবাদী জমির আমরা খাজনা নিয়েছিলাম।’ পরে নানা কথার সৃষ্টি হওয়ায় জেলা প্রশাসকের নির্দেশে এ ধরনের খাজনা নেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, পুকুর খননের সুযোগ করে দিতে আবাদি জমিকে পুকুর হিসেবে দেখিয়ে খাজনা আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। এমন কাজ কেউ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া কোন নিয়ম ছাড়াই চলছে বাগাতিপাড়ার জামনগর পুকুরপাড়া গ্রামের ইদ্রীস আলী মাস্টার ও স্বরাপপুর গ্রামের আব্দুল মজিদের পুকুর খনন। অথচ দিনে রাতে চলছে এমন পুকুর খনন।