নিউজ ডেস্ক:
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়েও রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করা যায়নি স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের। তৈরি হয়নি নির্ভুল, সঠিক পূর্ণাঙ্গ তালিকা। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দাবি, সঠিক ও নির্ভুল তালিকা তৈরির জন্য সময় বেশি লাগছে। এজন্য সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাহজাহান খানের নেতৃত্বে একটি উপকমিটি কাজ করছে। নির্ভুল তালিকার জন্য প্রতিটি উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তালিকা তৈরির কাজ করছে। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করবে। চলতি মার্চে স্বাধীনতা দিবসের আগেই রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সঠিক তালিকা প্রকাশ করা কঠিন। তাই সময় লাগছে। রাজাকারের একটি তালিকা আছে। সেটি রেকর্ড অনুসারেই করা হয়েছিল। সেখানে কিছু ত্রæটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা হয়েছে। দুদিনের মধ্যেই ওই তালিকা অপসারণ করা হয়। এখন পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
বিজয়ের পরপরই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার-১৯৭২’ (দালাল আইন) অনুযায়ী ক্ষমা না পাওয়া ১১ হাজার রাজাকারের বিচারের উদ্যোগ নেন জাতির পিতা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বেকসুর খালাস দেয়া হয় ১১ হাজার যুদ্ধ বন্দিকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ফের রাজাকারের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবসের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে ১০ হাজার ৭৮৯ জন স্বাধীনতাবিরোধীর তালিকা প্রকাশ করা হলেও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম আসায় বিতর্কের কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। রাজাকারের তালিকা নিয়ে বিতর্ক এবং তা প্রত্যাহার হওয়ায় নিজেরাই কাজটি করার উদ্যোগ নেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ জন্য ২০২০ সালের ৯ আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি সংসদীয় উপকমিটি গঠন করে। শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন ওই কমিটিতে ছিলেন রফিকুল ইসলাম, রাজিউদ্দিন আহমেদ, এ বি তাজুল ইসলাম, ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও মোসলেম উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু এই কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে পারছিল না। আবার বৈঠক ডাকলেও কোরাম পূর্ণ হতো না। পরে ২০২২ সালের এপ্রিলে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আগের উপকমিটি বাতিল করে শাজাহান খানকে আহ্বায়ক রেখে নতুন কমিটি করা হয়। নতুন উপকমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন- জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের এ বি তাজুল ইসলাম।
৫৩ বছরেও রাজাকারের তালিকা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না- এমন মন্তব্য তাদের। সংশ্লিষ্টদের মতে, নিয়াজির বইয়ে ৫০ হাজার লোককে রিক্রুট করার কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে দালাল আইনে ক্ষমা না পাওয়া ১১ হাজার রাজাকারের নামের তালিকা
নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখনো রয়েছে। সবমিলিয়ে ৫০ হাজারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। ওই নামগুলোর সঙ্গে কিছু নাম সংযোজন করা হলেই পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, ইতিহাসবিদ, গণহত্যা আর্কাইভ জাদুঘরের ট্রাস্টি সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, বিজয়ের পরপরই বঙ্গবন্ধু সরকার দালাল আইনে বিচার শুরু করলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বেকসুর খালাস দেয়া হয় ১১ হাজার যুদ্ধ বন্দিকে। বঙ্গবন্ধুর সময় করা রাজাকারের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। সেখানে কিছু নাম শুধু যোগ করলেই তালিকা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের সহযোগিতা প্রয়োজন।
৫০ হাজার রাজাকার : পাকিস্তানিবাহিনীকে সহায়তার জন্য একাত্তরের মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতারা নেতৃত্বে পান। প্রথমে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ কে নিয়াজি। পরে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেয়া হয়। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংসের গবেষণা অনুযায়ী, রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। জেনারেল নিয়াজী তার বইয়ে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয়। পাকিস্তানপন্থি পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হতো ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে। ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’, এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামেগঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক হিসেবে।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকার মতোই রাজাকারের তালিকা জরুরি মন্তব্য করে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতিটি এলাকায় রাজাকারদের নাম টানিয়ে রাখা প্রয়োজন- যেন মানুষ জানতে পারে, ওই এলাকায় কারা কারা স্বাধীনতাযুদ্ধে মীরজাফরের ভূমিকায় ছিল। আমরা দীর্ঘদিন রাজাকারের তালিকার জন্য আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও রাজাকারের তালিকা না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছেন, রাজাকার, আলশামস বা জামায়াতে ইসলামী- যারা ঘোষণা দিয়ে সাংগঠনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাদের তালিকা প্রকাশের জন্য ইতোমধ্যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে এবং আমাদের এই কাজ চলমান আছে। চলতি মার্চ মাসে পুরো তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হবে।