নিউজ ডেস্ক:
বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও সচল ছিল দেশের রপ্তানি খাত। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে চায় সরকার। চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনার প্রকোপ থেকে সহসাই মুক্ত হচ্ছে না বিশ্ব। এ জন্য সরকার করোনার মধ্যেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আশাবাদী। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ এবং আগের ধারা অব্যাহত রাখতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনার বিস্তৃতি বাড়ানো হয়েছে। সেসব দিক বিবেচনায় নিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
অর্থবছরের প্রথম মাসেই প্রণোদনার অর্থছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। ঈদের আগমুহূর্তে দেশি বস্ত্র, হিমায়িত চিংড়ি, বিভিন্ন মাছ, চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত দ্রব্যসহ অন্য খাতের রপ্তানিকারকদের জন্য প্রণোদনার ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে দেওয়া ১ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনার অর্থও রয়েছে। প্রণোদনার টাকায় যেন অনিয়ম না হয়, সে জন্য আটটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। গত ১৩ জুলাই প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কাছে পাঠানো চিঠিতে এ শর্তের কথা জানানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগের অধীনে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার আওতায় পাটজাত দ্রব্য খাতে প্রথম কিস্তি বাবদ ২০০ কোটি এবং রপ্তানি ভর্তুকি খাতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকাসহ এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে ছাড় করা হয়েছে। সরকারের শর্তগুলো হচ্ছে- প্রথম কিস্তিতে ছাড় করা অর্থ দিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুকূলে খাতভিত্তিক নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে। নগদ সহায়তার দাবি পরিশোধের পর নিরীক্ষায় প্রাপ্য অর্থের চেয়ে বেশি নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট অর্থ আদায় করে গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া
হবে। ব্যবস্থা গ্রহণের পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে জানাতে হবে। নগদ সহায়তার অর্থ ব্যয়ে প্রচলিত সব আর্থিক বিধিবিধান ও অনুশাসন এবং বিভিন্ন খাতে প্রদানের নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। অর্থগ্রহীতাকে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে অঙ্গীকার দিতে হবে যে, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ বা অন্য কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে যে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে এবং প্রদত্ত অর্থ ফেরত প্রদানে বাধ্য থাকবেন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে রপ্তানি খাতে নগদ সহায়তা
ও ভর্তুকি পরিশোধে বিদ্যমান পদ্ধতি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে একটি বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রতিবেদন অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে, যা নগদ সহায়তা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করবে। কেবল প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সংযুক্ত তহবিল থেকে উত্তোলন করা যাবে। নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি পরিশোধের নিমিত্ত ছাড় করা অর্থের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এবং এই অর্থের মধ্যে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, সেদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
রপ্তানি করতে গিয়ে অন্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। তাই রপ্তানিকারকদের নগদ টাকা দিয়ে সহায়তা করে সরকার। তবে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর কূটচাল করে অতীতে অনেক ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি না করেই সরকারের নগদ সহায়তার টাকা তুলে নিয়েছেন। কেউ কেউ একবার রপ্তানি করে এর বিপরীতে দুবার নগদ সহায়তা নিয়েছেন- এমন প্রমাণও পেয়েছে অর্থ বিভাগ। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে রপ্তানিমূল্য বেশি দেখিয়ে এর সঙ্গে জাহাজ ভাড়া যোগ করে বাড়তি নগদ সহায়তা নেওয়ার অভিযোগও আছে। তাই চলতি অর্থবছরে যেন এসব অনিয়ম না ঘটে, সে জন্যই সরকার রপ্তানির নগদ সহায়তা পেতে আটটি শর্ত দিয়েছে। কেউ শর্তগুলো ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ নগদ অর্থ জরিমানা করা হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্র আরও জানিয়েছে, ছাড় করা অর্থের ভিত্তিতে মহাহিসাব নিরীক্ষক (সিজিএ) ডেবিট অথরিটি জারি করবে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে প্রাপ্ত ভর্তুকি দাবির বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি হিসাব করে রপ্তানি ভর্তুকি পরিশোধ করতে পারবে।
জানা গেছে, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘রপ্তানি আয়ের এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে না। গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯৫ ভাগ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য ছিল ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সেবা খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে পণ্য খাতে ৩৮.৭৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সেবা খাতে ৬.৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার ৯৪.৫৬ ভাগ অর্জিত হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণের সময় দেশের এবং আন্তর্জাতিক সব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, এর মধ্যে ৪৩.৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হবে এবং ৭.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সেবা রপ্তানি হবে। এবার ১২.৩৭ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশের রপ্তানির ধারা অব্যাহত থাকলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের রপ্তানি খাত সচল আছে। রপ্তানি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে আমাদের রপ্তানি খাতে প্রণোদনা দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বাজার সম্প্রসারণে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ এসেছে। রপ্তানি বাড়ানোর জন্য রপ্তানিকারক এবং রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। আমরা সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন কাজ হবে না।’
টিপু মুনশি বলেন, বর্তমান ব্যবসাবান্ধব সরকার দেশের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। সরকার বেশকিছু খাতকে পণ্য রপ্তানিতে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আমাদের দেশের তৈরি পোশাকের পাশাপাশি লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি, লেদার ও লেদারগুডস, প্লাস্টিক এবং কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা আছে। এ খাতগুলোকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বিশ^ব্যাংক ঢাকা অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের অর্থনীতি ভালো করেছে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত সচল ছিল। দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে বিশ^ অর্থনীতিও বড় ভূমিকা রেখেছে। আমেরিকায় রপ্তানি বেড়েছে। আশা করি, আগামীতে ইউরোপেও রপ্তানি বাড়বে।