বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের দারুণ উপলব্ধি- “২০১৪-১৫ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের নিষ্ফল আন্দোলন করতে গিয়ে দলের যে ক্ষতি হয়েছে তা পরের ৪-৫ বছরেও পুষিয়ে ওঠা যায়নি।”
তিনি দলের ক্ষতির কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কী ক্ষতি করেছেন, মানুষের কী ক্ষতি করেছেন সেটা বলেননি। কাদের উস্কানি ও নির্বুদ্ধিতায় এ ক্ষতি, সেটাও বলেননি। তিনি “আন্দোলন নিষ্ফল ছিল” সেটা বলেছেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের প্রত্যক্ষ সহযোগী জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে পেট্রল বোমা ও বহুবিধ সন্ত্রাস নির্ভর আন্দোলন করতে গিয়ে জনজীবনে যে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ডেকে এনেছিল বিএনপি, সেটা বলেননি।
খালেদা জিয়ার দুঃশাসনের আমলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের হাওয়া ভবন দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। ২০১৪-১৫ সালের আন্দোলন তো ছিল বাংলাদেশের জন্য সেই অন্ধকার সময় ফিরিয়ে আনার অপচেষ্টা। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসের নিষ্ফল আন্দোলনে উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা- এ হিসাব ছিল সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর। সহিংসতায় মৃত্যু ঘটেছিল অন্তত ১৩৮ জনের। এর অর্ধেকের বেশি নিহত হয়েছিল লল্ডন থেকে গায়েবী আওয়াজে আসা অপনির্দেশে। তারেক রহমানের কৌশল ছিল, পেট্রল বোমা নিক্ষেপ ও অন্যান্য ধরনের নাশকতা চালিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানো এবং বাংলাদেশের জন্য সেই পাকিস্তানি দুঃসময়ের শাসন ফিরিয়ে আনা। মির্জা ফখরুল ইসলাম কিন্তু ভুল আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। কারণ এমন নির্দেশ নেই লন্ডনের। যে ভয়ঙ্কর অপরাধ নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে করা হয়েছে সে জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। বিএনপির তা থাকার কথাও নয়।
দলটির বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধও নেই। যারা পেট্রল বোমা মেরে যারা মানুষ হত্যা করেছে, অর্থনীতির অপরিমেয় ক্ষতি করেছে, তাদের ফের মাঠের রাজনীতি করার অধিকার কোনো গণতান্ত্রিক দেশে দেওয়া হয় না। কিন্তু শেখ হাসিনা সুযোগ দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন নির্ধারিত হয়। এতে বিএনপি অংশগ্রহণের পূর্ণ সুযোগ পায়। কিন্তু কয়লা ধুলে যে ময়লা যায় না। তারা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে মির্জা আব্বাসকে প্রার্থী ঘোষণা করে, যিনি নিজেই সন্ত্রাসী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তারেক রহমানের দক্ষিণ হস্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, উত্তরে মনোনয়ন দেওয়া হয় ধনকুবের আবদুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র তাবিথ আউয়ালকে। মির্জা ফখরুল যে আন্দোলনকে নিষ্ফল বলছেন এখন, তার পেছনে অর্থ জোগানদাতা কারা- সেটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের রয়েছে।
তারিথ আউয়াল ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র পদে ফের বিএনপির প্রার্থী। নির্বাচনের বেশ আগেই তাঁর ক্রেডেনশিয়ালে একটি ‘স্বর্ণপালক’ পালক যুক্ত হয়েছে; বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। তার পিতা, মাতা ও অপর দুই ভাইও প্যারাডাইস পেপারস-এর অর্থপাচারকারীদের তালিকায় ‘সমুজ্জ্বল’। তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছেন, তাতে বছরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয় হয় বলে জনশ্রুতি। টাকা থাকলে ডিগ্রি মেলে, সেটাও কিন্তু জনশ্রুতি।
অন্যদিকে, দক্ষিণের মেয়র পদে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের সুনির্দিষ্ট মামলা। যে দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এতিমের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ আত্মসাৎ করতে পারেন, তারা মেয়র পদের জন্য নিজেদের মতো ‘যোগ্য প্রার্থী’ বেছে নেবেন, তাতে আর বিচিত্র কী। কথায় বলে, রতনে রতন চেনে…।
মাত্র এক বছর আগেই ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সরকার পতনের সন্ত্রাসনির্ভর আন্দোলনে চরম বিপর্যয়ের পর মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য এটা ছিল বিএনপির জন্য চমৎকার সুযোগ। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা আবারও তাদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা গ্রহণের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকতে হয়। দেশের প্রতি দরদ থাকতে হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সেটা আদৌ ছিল না। এ দলের ভেতর থেকেই অভিযোগ ওঠে- লন্ডনে বসে তারেক রহমান প্রতিটি আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করে দেন। তবে প্রতিটি আসনে একজন নয়, তিনি মনোনয়ন দেন কয়েকজন করে প্রার্থী। ধানের শীষের প্রকৃত প্রার্থী কে সেটা সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতা-কর্মীরা বুঝতেই পারছিলেন না। শুধু তাই নয়, জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন প্রার্থীকেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে দেওয়া হয়। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের এ দলের নিবন্ধন ছিল না। বিএনপির বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীরা দলের অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বলেছেন- প্রায় সকল আসনে অর্থের বিনিময়ে প্রার্থী করা হয়েছে। একজনকে ধানের শীষ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আরেকজনের কাছ থেকে বেশি টাকা পেয়ে তার নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তৃতীয় কেউ বেশি টাকা দিলে তার হাতে দেওয়া হয়েছে ধানের শীষ।
ধর্নাঢ্য পরিবারের সন্তান, যিনি বাইরে বিপুল অর্থ পাচার করার ক্ষমতা রাখেন তাকে পর পর দু’বার সিটি করপোরেশন নির্বচনের মেয়র প্রার্থী করার পেছনে এমন রহস্য নেই তো? মনি-কাঞ্চন যোগ বলে কথা! লন্ডনে বিলাসী জীবন কাটাতে অঢেল অর্থ চাই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা রুখতে ষড়যন্ত্র-সহিংসতা নির্ভর রাজনীতির জন্য তারচেয়েও বেশি অর্থ চাই। যিনি অর্থের জোগান দিতে সবচেয়ে পারঙ্গম ব্যক্তিদেরই তো মনোনয়ন দিতে হবে। বিএনপির একাধিক নেতা একান্তে বলেছেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর তাবিথ আউয়ালকে ঢাকা উত্তরের মানুষ একদিনের জন্যও কাছে পায়নি। তাকে কেন ফের প্রার্থী করা হলো?
বিএনপির এ সিদ্ধান্তে রাজধানী ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের অধীন দুই কোটির বেশি মানুষের কোনো কল্যাণ নেই। তারা আধুনিক, উন্নত মহানগর চায়। সহজে যাতায়াতের সুযোগ চায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত যে বাংলাদেশের পথে সাহসী অগ্রযাত্রা, তাতে পথিকৃত হিসেবে দায়িত্ব পালনের মতো সিটি করপোরেশন নেতৃত্ব চায়। আওয়ামী লীগ এ দায়িত্ব পালনের জন্য ২০১৫ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে আসিনুল হককে মনোনয়ন দিয়েছিল। মাত্র দু’ বছরের কিছু বেশি সময় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেমন মেয়র চাই, স্থানীয় সরকারের আদর্শ জনপ্রতিনিধি কেমন হওয়া উচিত- তার স্ট্যান্ডার্ড হয়ে আছেন তিনি। দলমত নির্বিশেষে মানুষ বলছে, আনিসুল হকের মতো মেয়র চাই। ঢাকা উত্তরে আতিকুল ইসলাম এক বছরও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই মানুষ বলছে- দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত সিটি করপোরেশনে এমন মেয়রই তো চাই। তিনি আনিসুল হকের যোগ্য উত্তরসূরী হতে পারবেন, সেটা স্পষ্ট। আর প্রার্থী মনোনয়নে দলের নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে তারা বলছে- বিএনপি নেতারা সব নির্বাচনেই তাদের দুর্বৃত্তের রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত প্রার্থী খোঁজে। আর আওয়ামী লীগের নজর জনকল্যাণ ও উন্নয়ন। যে যার মতো রতন চিনে নেয়।