- এনডিসি ও এএফডব্লিউসির গ্র্যাজুয়েশনে প্রধানমন্ত্রী
জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘অগ্রসেনা’ হিসেবে কাজ করবে বলে আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সরকারের নেয়া প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ‘অগ্রসেনা’ হিসেবে কাজ করবে বলে আমি আশা করি। আর ২০৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তি হবে, সেটাও মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
বৃহস্পতিবার ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০২১ (এনডিসি)’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস ওয়ার কোর্স-২০২১ (এএফডব্লিউসি)’-এর গ্রাজুয়েশন সেরিমনিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টস্থ ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এ্যান্ড স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) শেখ হাসিনা কমপ্লেক্সে সংযুক্ত হয়ে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এবারে এনডিসিতে ২৭ জন বিদেশী সামরিক সদস্যসহ মোট ৮৮ জন এবং এএফডব্লিউসিতে মোট ৫৫ জন প্রশিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। তিন বাহিনী প্রধান এবং এনডিসি কমানড্যান্ট অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
সরকারপ্রধান বলেন, আমি জেনে আনন্দিত যে, এ পর্যন্ত ২৪টি বন্ধুপ্রতিম দেশের ৩৮৩ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এনডিসিতে উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। সময়ের পরিক্রমায় এনডিসি কোর্সের সদস্য সংখ্যা এবং একাডেমিক কার্যক্রমের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সীমিত সম্পদ, অবকাঠামো ও জনবল দিয়েও এনডিসি সফলভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে- এ জন্য আমি এনডিসির কমান্ড্যান্ট এবং তার টিমকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিকট ভবিষ্যতে এ সকল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য তার সরকার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, আপনাদের অনেকেই কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে দীর্ঘ প্রায় এক বছর কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলন করেছেন। এনডিসিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জাতীয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেছেন, যা নিঃসন্দেহে আপনাদের কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব অর্জনে সহায়ক হবে। আমি আশা করি, এই কোর্স দু’টিতে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সামরিক সদস্যগণের সঙ্গে আমাদের সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা সর্বোপরি আমাদের প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে যে নিবিড় মিথষ্ক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে অটুট থাকবে। তিনি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথাও পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সশস্ত্র বাহিনী দুর্যোগ মোকাবেলার পাশাপাশি দেশের অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং শান্তি নিশ্চিতকরণে দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। আমরা আবারও সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে গৌরবের স্থানটি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নে তার সরকারের পদক্ষেপের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ’, ‘মিলিটারি ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজি’ এবং ওয়ার কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং’ এবং ‘আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করি। আমরাই প্রথম ২০০০ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ করি।
টানা তৃতীয়বারের মতো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে একটু সময়ও পেয়েছি দেশের সেবা করার। প্রশিক্ষিত ও যুগোপযোগী সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করছি। জাতির পিতার ’৭৪ সালে প্রণীত প্রতিরক্ষা নীতিমালা অনুসরণে আমরা ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশ পিস বিল্ডিং সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছি। ‘জাতীয় প্রতিরক্ষানীতি-২০১৮’ প্রণয়ন করেছি। আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতার এই মূলমন্ত্রকে পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে মেনে চলছি। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অন্য দেশের বাহিনীর সঙ্গে আমাদের সশস্ত্রবাহিনী যাতে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, সে জন্য এতে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সংযোজন এবং এর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও তুলে ধরেন।
করোনা মহামারীর সময়ও দেশের সকল মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ এবং ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সে জন্যই এই করোনা মহামারীর মধ্যেও আমাদের আর্থসামাজিক অগ্রগতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। ‘মুজিবশতবর্ষ’ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’ অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। শতবর্ষ মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন শুরু করেছি।
জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জন এবং ’৭৫’র বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম, বিজয়ী জাতি হিসেবে বিশ্বে একটা মর্যাদা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ’৭১ এর পরাজিত শক্তির এ দেশীয় দোসররা আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতাকে ম্লান করে। দেশের স্বাভাবিক উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেয়। মহান স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছরে জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দেশকে টেনে তুলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে দেশকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যান।
’৭৫ পরবর্তী দেশে হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির গোড়াপত্তনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯ বার সামরিক বাহিনীতে ক্যু হয়েছে। বহু সামরিক অফিসার, জোয়ান, সৈনিক, সাধারণ মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। অনেক পরিবার নিহত আপনজনের লাশের সন্ধান পায়নি। এমনই একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ২১টি বছর কেটেছে। এরপর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়, যে জন্য তাকে এবং পরিবারের প্রাণে বেঁচে যাওয়া ছোট বোন শেখ রেহানাকে ’৭৫ এর পর বিদেশে নাম-পরিচয় গোপন রেখে রিফিউজি জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয়। আবার দেশে ফিরেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এক রকম জোর করেই দেশে ফিরে আসার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় তার বাবা, মা, ১০ বছরের ছোট ভাই রাসেলসহ ভাইদের এবং ভাতৃবধূসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যাকারীরা এবং ’৭১ এর গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা ক্ষমতায় ছিল। তাদের কেউ কেউ মন্ত্রী বা উপদেষ্টা এবং জাতির পিতার খুনীরা বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি লাভ করে পুরস্কৃত হয়েছিল। কারণ, খুনের বিচার যেন না হতে পারে সে জন্য আইন করা হয়েছিল, খুনীদের ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেয়া হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, তেমনই একটা অবস্থার মধ্যে আমি জীবনকে বাজি রেখে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলাম। একটা লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলাম যে, স্বাধীনতার জন্য আমার বাবা সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জেল খেটেছেন, আমরা ভাই-বোনেরা বাবার ¯েœহবঞ্চিত থেকেছি, বাবার পাশে থেকে আমার মা আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সে জাতি অন্ধকারে পড়ে থাকবে এটাতো হতে পারে না। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের হারিয়ে ফেলা চেতনাকে ফিরিয়ে আনা এবং বাংলাদেশকে জাতির পিতার আদর্শে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই আমার ফিরে আসা। আজও সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।