কম্বোডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বেশ আয়োজন করে উৎসবমুখর পরিবেশে এ খেলার আসর বসে
বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
কম্বোডিয়ায় মোরগলড়াই বেশ প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী খেলা। খেমের ও তাদের মোরগের ভাস্কর্য এবং মোরগলড়াইয়ের বিভিন্ন দৃশ্যপট কম্বোডিয়ার বায়ন মন্দিরের পাথরে খোদাই করা আছে, যা এ খেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। বেশ প্রাচীনকাল থেকেই খেমেররা একঘেয়ে সময়কে আনন্দময় করে তোলার জন্য এ খেলার আয়োজন করে আসছে। সাধারণত বিভিন্ন উৎসবে, সাপ্তাহিক বা অন্যান্য ছুটির দিনে এবং ধান কাটার মৌসুম শেষে এ খেলার আয়োজন করা হয়। কম্বোডিয়ার শহর ও গ্রামে এ খেলা এখনো ভীষণ জনপ্রিয়। এমনকি কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত সময়েও মানুষ নিজেদের চাঙ্গা রাখতে মোরগলড়াইয়ের আয়োজন করত।
যদিও প্রাচীনকাল থেকে মোরগলড়াই সাধারণত নিছক বিনোদনের উপাদান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে এসেছে। তখন জয়ী মোরগের মালিককে নতুন ধানের বিয়ার বা ওয়াইন উপহার দেওয়া হতো। আর মোরগের জন্য এক বস্তা নতুন ধানের চাল। দিনে দিনে এ খেলার ধরন ও চিন্তা-ভাবনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে খেমেররা শুধু বন্ধুত্বের জন্য নয় বরং অর্থের জন্য এ খেলার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। তাই টাকা দিয়ে জুয়া খেলার প্রচলন হওয়ায় মাঝেমধ্যেই প্রশাসন এর উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসে।
কম্বোডিয়ার বাটাম্বাং প্রদেশের মোরগ লড়াইয়ের জন্য সবচেয়ে কঠিন যোদ্ধা হিসাবে প্রমাণিত। এ অঞ্চলের মোরগগুলোকে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের শক্তিশালী মোরগের সাথে শংকরায়ণ করা হয়েছিল। পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে এসব মোরগকে লড়াইয়ের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। মোরগগুলোর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য পুষ্টিকর খাবার যেমন- বাদাম, ঘি, মাখন, গরুর মাংস, ডিম, দুধ, ভিটামিন প্রভৃতি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে লড়াইয়ের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ব্যায়াম, প্রশিক্ষণ ও খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমে মোরগগুলোর ফিটনেস ধরে রাখতে কাজ করতে হয় মালিককে।
খেলা শুরুর আগে মোরগের খেলোয়াড়রা নিজেদের মোরগ নিয়ে সমকক্ষ জোড় খোঁজার জন্য অন্যান্য মোরগের সামনে রেখে পরীক্ষা করে দেখে নেয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগ নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। মোরগের সমান সমান জোড় না হলে লড়াই করা সম্ভব নয়। তাই ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু কাছাকাছি শক্তিশালী মোরগের সাথে লড়াই হয়। যেমন- বন মোরগ, কাওড়া মোরগ ও জংলি মোরগ ইত্যাদি। রক্তমাতাল হওয়া মোরগ লড়াইয়ের জন্য ঘাড়ের পালক ফুলিয়ে মোরগরা তৈরি হয়। তবে লড়াইয়ের আসরে দেখা যায় মোরগকে রাগানোর জন্য নানাপ্রকার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় এবং সেটি করে খেলোয়াড়রা।
মোরগের পায়ে অস্ত্র বাঁধার জন্য কাঁতিদার থাকে। কাঁতিদার চটের উপর কাঁত, চামড়া টুকরো সুতো নিয়ে বসে থাকে। আর এরাই মোরগের পায়ে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বেঁধে দেয়। যেমন- সোজা ফলি, বাঁকা ফলি, লোহার ধারালো অস্ত্র বাঁধা হয়। এসব অস্ত্রে তুঁতে মাখানো থাকে। যাতে খুব সহজে ঘায়েল করা যায়। একটি ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, যখন মোরগের লড়াই চলে তখন দর্শকদের হাততালি দেওয়া নিষিদ্ধ। এটা তাদের নিয়ম। তবে অনেক সময় মোরগের লড়াইকে কেন্দ্র করে স্থানীয় খেমেরদের মাঝে ঝগড়া ও মারামারি হয়। এসব অশান্তি ঠেকাতে অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসন ভূমিকা পালন করে। এসব সত্ত্বেও মানুষের আনন্দ, আমোদ, প্রমোদ করার জন্য কম্বোডিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বেশ আয়োজন করে উৎসবমুখর পরিবেশে এ খেলার আসর বসে।
মোরগলড়াইকে বিশ্বের প্রাচীনতম খেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় ৬ হাজার বছর আগে প্রাচীন পারস্যে এ খেলার উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্ভবত ভারতীয় লাল বনমোরগ ব্যবহারের মাধ্যমে এ খেলার ব্যুৎপত্তি ঘটেছিল। যা পরবর্তীকালে সব ধরনের গৃহপালিত মোরগকে এ লড়াইয়ে যুক্ত করে। ধারণা করা হয়, ভারত, প্রাচীন পারস্য, চীনসহ অন্যান্য পূর্বাঞ্চলীয় দেশে এ খেলা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এ খেলা খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৪-৪৬০ সালে গ্রিসে প্রবেশ করে। এরপর তা এশিয়া মাইনর ও সিসিলির মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে যায়।
রোমও গ্রিসে প্রচলিত মোরগের লড়াইয়ের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোম থেকে তা উত্তরাঞ্চলের দিকে প্রসারিত হয়। খ্রিষ্টিয় ধর্মগুরুগণ এ উন্মত্ত লড়াইয়ের বিরোধিতা করলেও ইতালি, জার্মানি, স্পেন ও এ দেশগুলোর উপনিবেশসমূহে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ডেও একই দৃশ্য প্রবাহিত হয়। মাঝেমধ্যেই কর্তৃপক্ষ মোরগের লড়াইকে উচ্ছেদের প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। ইংল্যান্ডে ষোড়শ শতকের শুরু থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত রাজন্যবর্গ ও উচ্চ পদবিধারীদের কাছে এ প্রতিযোগিতা বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মোরগলড়াইয়ের কথা ১৬৪৬ সালে প্রথম প্রামাণ্য দলিলে উল্লেখ করা হয়। এর আগে অবশ্য জর্জ উইলসন ১৬০৭ সালে তার দ্য কমেন্ডেশন অব কক্স অ্যান্ড কক ফাইটিং বইয়ে খেলাধুলায় মোরগ নামে ব্যবহার করেন।
সূত্র: জাগো নিউজ