নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে চারদিকে যখন নেতিবাচক খবর, তখন প্রবৃদ্ধিতে আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোতে উন্নতি করে প্রবৃদ্ধিতে পেছনে ফেলছে প্রতিবেশী দেশগুলোকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, মহামারির মধ্যেই চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।
শুধু ভারতই নয়, চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং এশিয়ার মধ্যে চতুর্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবৃদ্ধিতে ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশকে ছাড়িয়ে যাওয়া বিরাট অর্জন। তবে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে না ভুগে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে।
বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদরা আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, করোনা মহামারি পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটবে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক দ্রুত। আমদানি-রপ্তানি ব্যয়ে ভারসাম্য, রেমিট্যান্সে সাফল্য, বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং জিডিপি অনুপাতে সরকারি ঋণ কম হওয়ায় অন্য দেশের তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তার পরও প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকছে বাংলাদেশ। যদিও সরকার এ বছরের বাজেটে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।
বাংলাদেশের এমন সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করে ভারতের সংবাদপত্র দ্য ইকোনমিক টাইমস বলেছে, ‘মধ্যবর্তী সময়ে (করোনা কাল) ভারতের সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ যখন ধীরে এগোচ্ছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের মধ্যে বড় মাপের প্রণোদনা প্যাকেজ, নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও অর্থনীতি খুলে দেওয়ার মতো সরকারের সাহসী পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুবিন্যস্ত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার কারণে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। এর মধ্যে বড় চমক ছিল লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা। এতে ভেঙে পড়েনি উৎপাদনপ্রক্রিয়া। পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে শুরু করে সুপারশপ, শপিং মল, বড় শিল্প-কারখানার চাকা সচল আছে। আমদানি-রপ্তানি, উৎপাদন, সরবরাহ, বিপণন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং পরিবহন চলাচল অনেকটাই স্বাভাবিক হচ্ছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান ও বিপণিবিতান খুলে দেওয়ায় বিশাল ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শ্রেণি কাজে ফিরেছে। তারা করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সরকারি হিসাবে তো ৮ শতাংশের ওপরে একটা আশাবাদ আছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফের হিসাব তো তার চেয়ে অনেকটা কম। তবে আমি সে তর্কে যাচ্ছি না। তার থেকে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যে সবাই একটা অ্যাগ্রিমেন্টে আছে। অন্যান্য দেশ যেখানে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিতে যাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ কিন্তু আসলে একটা পজিটিভ প্রবৃদ্ধিতে আছে। সেটার মাত্রা নিয়ে হয়তো কিছু কথা থাকতে পারে। তাই আমার কাছে মনে হয় এটা আশাবাদী হওয়ার মতো একটা বিষয়।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার আঘাতের পরও বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করছে—এটি অত্যন্ত আশার খবর। আমাদের কিছু শক্তিশালী সূচক আছে যেগুলোর কারণে আমরা ভালো করছি। এখন আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।’
এদিকে সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সরকার সহজেই মোকাবেলা করতে পারবে। সবাই একসঙ্গে কাজ করলে অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করা খুবই সম্ভব। করোনা সংকটের মধ্যেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন রেকর্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এবার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলার, যা দিয়ে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এই নিয়ে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সাতবার নতুন মাইলফলক অতিক্রম করল রিজার্ভ। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক ঋণ সহায়তার ওপর ভর করে রিজার্ভ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে।
এক মাসের হিসাবে গত সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয় ফের ২০০ কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করেছে। এ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২১৫ কোটি ডলার, যা একক মাস হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এটি গত অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে সাড়ে ৪৫ শতাংশ এবং আগের মাসের চেয়ে সাড়ে ৯ শতাংশ বেশি।
আর জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে রপ্তানি গতবারের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৫৮ শতাংশ।
করোনাকালে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে কৃষি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৫.৪৪ শতাংশ অবদান কৃষি ও সেবা খাতের। কর্মসংস্থানেও বড় ভূমিকা রাখছে খাতটি। আয় কমে যাওয়ায় শহরত্যাগী মানুষগুলোকেও ধারণ করেছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
অন্যদিকে করোনায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও ভালো পারফরম করছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে পুঁজিবাজারের উত্থানে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। এমনকি ২৪.৪ শতাংশ উত্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এই সাফল্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। তবে এই দেশ দুটিও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ, বৈদেশিক বাণিজ্য, রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এসব ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারা চলছে। এ ছাড়া ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে। কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি।
আইএমএফ প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে (ডাব্লিউইও) বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এ কারণে বিশ্ব অর্থনীতি সঙ্কুচিত হবে ৪.৪ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
ডাব্লিউইও রিপোর্টে বলা হয়, ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১০.৫ শতাংশ কমে এক হাজার ৮৭৭ ডলার দাঁড়াতে পারে, যা হবে চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। ২০২০ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়ে ৩.৮ শতাংশ দাঁড়িয়েছে, ২০২১ সালে এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৪.৪ শতাংশ দাঁড়াবে। করোনাভাইরাস মহামারির রোধে দেশব্যাপী কড়া লকডাউনের কারণে তীব্র অর্থনৈতিক সংকোচনে ভারতের এই প্রবৃদ্ধি হ্রাস ঘটেছে।
ম্যানিলাভিত্তিক সংস্থা এডিবি বলছে, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স সাফল্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই সঙ্গে কাটছে করোনা মহামারি সংকট। ফলে আশা করা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৬.৮ শতাংশ।
বাংলাদেশে এডিবির আবাসিক প্রধান মনমোহন প্রকাশ বলেছেন, ‘মহামারি থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার পেতে শুরু করেছে। চলমান মহামারির মধ্যেও সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ও সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা অর্থনীতিকে সুসংহত করেছে।’
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড লি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ মন্দার মাঝেও আসিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ এ বছর ইতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে যাবে। বাংলাদেশ এর অন্যতম, অন্য দেশটি ভিয়েতনাম।’ তিনি বলেন, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের সব দেশের জন্যই চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক ছিল সবচেয়ে খারাপ। সেখানেও পুনরুদ্ধার দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ।’ দক্ষিণ এশিয়ায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের অর্থনীতিবিদ সৌরভ আনন্দ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মন্দার যে ঝড় এসেছিল তা এরই মধ্যে কেটে গেছে।’
অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা যাঁদের পাওয়ার কথা তাঁরা যাতে পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাঁরা কাজ হারাচ্ছেন, তাঁদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পগুলোকে আরো জোরদার করতে হবে এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে যাতে দুর্নীতি না হয়, সেটি দেখতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে।’
অর্থনীতি ও বিনিয়োগ বিশ্লেষক মামুন রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স করে ব্যবসার পরিবেশ দ্রুত উন্নত করতে হবে।’