নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বেড়েছে আরও আগেই। বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের সক্ষমতাও বেড়েছে। এরই মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নামও লিখিয়েছে লাল সবুজের বাংলাদেশ। পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সক্ষমতারও জানান দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীদের। এ ছাড়া মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, বে-টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে করোনা মহামারীতেও। থার্ড টার্মিনাল প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিক ও প্রকৌশলীরা দিনরাত কাজ করছেন। প্রায় একই দৃশ্য চোখে পড়েছে মেট্রোরেল লাইন-৬-এর বেলায়ও। আবার রিজার্ভ থেকে ঋণ দিয়ে বৈদেশিক ঋণদানের ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যার মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা থেকে ঋণদাতার তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার রিজার্ভেরই একটি অংশ ব্যয় করা হবে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিতে আমরা সব রকম প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছি। এখন শুধু শ্রীলঙ্কার আনুষ্ঠানিক রেসপন্সের অপেক্ষা।’ তারা চাইলে তাদের চাওয়া সময় অনুযায়ী এ লেনদেন সম্পন্ন হবে বলে জানান তিনি। সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘এটি অবশ্যই আমাদের দেশের জন্য গর্বের বিষয়। শুধু তাই নয়, এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণমানের জন্য একটি বড় ধরনের ইতিবাচক মাইলফলকও। একসময় আমরা শুধু বিদেশি সংস্থা বা দেশের কাছ থেকে ঋণ নিতাম। সেদিন বদলে গেছে। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সক্ষমতায় আমরা এখন অনেকের কাছে অনুকরণীয়।’
এদিকে করোনা মহামারীতে যেখানে উন্নত বিশ্বের বহু দেশ বিপর্যস্ত সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি তার সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা ঠিকমতোই সামলে নিয়ে এখন দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কাও সামাল দিচ্ছে। সরকারসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেকখানি বাড়বে। যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে আনবে আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তনই মূলত বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়ে ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠনের পর পরই সারা দেশে শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড। দ্বিতীয় মেয়াদেও সরকার অপরিবর্তিত থাকায় সে উন্নয়ন কর্মকান্ড আরও গতি পায়। ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় শুরু হয় ধাবমান ঘোড়ার মতো উন্নয়ন কর্মকান্ড। দীর্ঘদিনের বাধা কাটিয়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে আসে অবিশ্বাস্য সাফল্য। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও টানা তৃতীয়বার জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর আগে দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি, রেলসহ সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বৃহৎ প্রায় এক ডজন প্রকল্পের কাজ শুরু করে সরকার। এগিয়েও যাচ্ছিল বেশ দ্রুতগতিতে। তরতর করে বাড়তে থাকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি। কিন্তু গত বছরের প্রথম দিকে সারা বিশ্বে শুরু হয় কভিড-১৯ মহামারী। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও নেমে আসে বিপর্যয়। দেড় বছর ধরে চলমান এ মহামারীর কারণে মেগা প্রকল্পগুলোর কাজের গতি কিছুটা স্তিমিত হলেও কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলছে এ প্রকল্পগুলোর কাজ।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের কাজে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। গত জুন পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন-৬-এর কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর পদ্মা সেতুর প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশের বেশি। আশা করা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে পদ্মা সেতু। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও থেমে নেই কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বাংলাদেশের প্রথম টানেল তৈরির কাজ। করোনা মহামারীর মধ্যেই নির্মাণসামগ্রী সরবরাহে বিঘ্ন, শ্রমিক সংকটসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছে কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যান চলাচলের জন্য উপযোগী করা নিয়ে আশাবাদী প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে মেগা এ প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭০ শতাংশ।
কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে স্বাভাবিক সময়ের মতো কাজের অগ্রগতি হচ্ছে না। করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী আসছে না। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কেউ ছুটিতে গেলে কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন পালনের কারণে এক মাসের আগে কাজে যোগ দিতে পারেন না। সব মিলিয়ে কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে। তবে প্রচেষ্টা রয়েছে দ্রুততার সঙ্গে প্রকল্পের কাজ শেষ করার।’
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৫ শতাংশের মতো। এ প্রকল্পের মেয়াদ জুন, ২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনের বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে বলে সেতু বিভাগসূত্রে জানা গেছে। পিছিয়েছে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজও।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। ফলে এসব মেগা প্রকল্প সমাপ্ত হলে বহির্বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হবে; যা বাংলাদেশকে এক অনন্য মর্যাদার আসনে নিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে দীর্ঘ অপেক্ষার পর অবশেষে আলোর মুখ দেখছে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু রেলসেতু। আগামী মাসে এ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর চাপ কমবে। ঝুঁকিও হ্রাস পাবে বঙ্গবন্ধু সেতুর। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর সেতুর ওপর দিয়ে সমান্তরালভাবে গাড়ি ও রেল চলাচল করে; যা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য খুবই ধীরগতিতে চলে রেল কোচ। শুধু তাই নয়, সেতুর দুই প্রান্তেই চলাচলের আগে বিরতি দিয়ে ইঞ্জিন চেক করতে হয় কোচগুলোর। বর্তমানে ওই সেতুতে অনুমোদিত গতিবেগ ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার। ফলে একটি ট্রেনের সেতুর পুব পাশের স্টেশন থেকে পশ্চিম পাশের স্টেশন যেতে প্রায় আধা ঘণ্টা লাগে। কিন্তু যমুনা নদীর ওপর পৃথকভাবে বঙ্গবন্ধু রেলসেতু নির্মাণ হলে সে ঝুঁকি আর থাকবে না। কমে আসবে ভ্রমণকালও। এতে যাত্রীদের সময়ের সাশ্রয় হবে। জ্বালানি খরচও কমবে রেল বিভাগের। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ থেকে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা সহজ হবে। কমবে পণ্য পরিবহন খরচ; যা ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। এটা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে মনে করে সরকার।