নিউজ ডেস্ক:
৯ মাস যুদ্ধের পর দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের অবসান ঘটলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হলো। পাকিস্তানিদের বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতন থেকে মুক্তি পেলো সাত কোটি মানুষ। প্রায় দুই যুগের দাসত্বের অবসান ঘটলো। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশে মানুষের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুফল পৌঁছানোর কোনো উপায় ছিল না। তাই স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম জনসভাতেই ঘোষণা করলেন, ‘বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পেয়ে সুখে থাকবে এটাই আমার সাধনা।’ তার হাত ধরে তীব্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এই জাতি যেভাবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে, ঠিক সেভাবেই নতুন দেশকে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন তিনি। নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা সম্পর্কে এদিন তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মের ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
সেই বছরই জাতীয় সংসদে আমাদের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধানে চারটি মূলনীতির কথা বলা হয়। সেগুলো হলো: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। বিশ্বের মানচিত্রে নতুন আত্মপ্রকাশ করা বাংলাদেশকে এই চার স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানোর ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। এই নীতিগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন, তা ছিল অভিনব ও চমকপ্রদ। স্বাধীনতার পথে যাত্রার মূলমন্ত্রগুলো এবং স্বাধীনতার পরে একটা মানবিক ও স্বাবলম্বী রাষ্ট্র গড়ে তোলার এই গভীর দর্শনই মুজিববাদ নামে পরিচিত লাভ করে।
দীর্ঘ সংগ্রামের অগ্নিপথ থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ দর্শন
তবে ‘মুজিববাদ’ টার্মটি স্বাধীনতার পরে পরিচিতি পেলেও এর শিকড় আরও অনেক গভীরে প্রোথিত। স্বাধীনতার পর সংবিধানের এই চারটি শব্দ হাওয়া থেকে এনে জুড়ে দেননি বঙ্গবন্ধু। বরং ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজদের শোষণের মধ্যে বেড়ে ওঠা শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য এবং পরবর্তীতে দেশভাগের পর পর পাকিস্তানিদের বৈষম্যের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ রাজপথ ও কারাগারের অন্ধকারে যৌবন কাটানো সময়গুলো থেকেই এই ধারণাগুলো অর্জন করেছেন তিনি। এই চার নীতির সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের পদযাত্রায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি সবসময় একটা কথা বলতেন, তা হলো- শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। এই শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গণতন্ত্র এ সমাজতন্ত্রের এক ব্যতিক্রমী সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এবং পরবর্তীতে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে, বিশ্বে প্রথমবারের মতো, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
শুধু গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতেই, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে বাংলায় ১৬৭ আসন জিতে পাঁচ বছরের ম্যান্ডেট থাকার পরও, স্বাধীনতার পর নির্বাচন দেন তিনি। ১৯৭২ সালজুড়ে বিধ্বস্ত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর প্রাথমিক সংষ্কার সাধন এবং সংবিধান প্রণয়ন করেন। এরপর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনেও দেশের আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে বিজয়ী করে। মূলত পুরো সংসদই ছিল আওয়ামী লীগের। এই সংসদে পরবর্তী পাঁচ বছর আওয়ামী যা চাইতো, একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তাই করা সম্ভব ছিল।
কিন্তু গণতন্ত্রের নামে যেন-তেনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা না করে, বঙ্গবন্ধু চাইলেন- সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। বাংলার ৮০ ভাগ গ্রামীণ মানুষের জন্য বৈষম্যহীন জীবন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। এজন্য স্বাধীনতার পরপরই পাটকল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কলকারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসেন। কিন্তু উগ্রপন্থী কয়েকটি বাম দল, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে তরুণদের বিভ্রান্ত একটা অংশ, কিছু প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের অপতৎপরতার কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হন। এরা স্বাধীনতার পরের তিন বছরে আওয়ামী লীগের চার জন এমপিসহ কয়েক হাজার ব্যক্তিকে হত্যা করে। শুধু ১৯৭৪ সালেই সর্বহারা, মাওবাদী ও জাসদের গণবাহিনী দ্বারা ১৫০টি ছোট-বড় হাট বাজার, ব্যাংকের প্রায় ৫০টি শাখা, ৪০টি থানা ও ফাঁড়ি লুট হয়। এমনকি ঘোড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোলরুম উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত করে উগ্রপন্থীরা। তারমধ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও একটা টাউট শ্রেণির উত্থানের কারণে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষ। সার্বিক পরিস্থিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। সমাজে অরাজতা শুরু হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে উত্তরণের জন্য, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে, এবার দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালে, জাতীয় সংসদের অনুমোদনক্রমে সংবিধানসম্মতভাবে মূলধারার সব দলকে নিয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ (বাকশাল)। বাকশাল গঠন করে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থার সংস্কারের ঘোষণা দেন তিনি। দেশকে ৬১ জেলায় বিভক্ত করে গর্ভনর নিয়োগ দেন। প্রতিটি জেলা এবং উপজেলাভিত্তিক প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থা চালু করার কাজ শুরু হয়। কিন্তু এটি বাস্তবায়নের আগেই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে সপরিবারের প্রাণ হারান এই সিংহ পুরুষ।
এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো সমান উন্নত হতো। কারখানা-বাণিজ্য-অফিস সবকিছুর কেন্দ্র হতো জেলা শহর, উন্নত শহরে পরিণত হতো প্রতিটি উপজেলা, যার সুবিধা পেতো প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষটি পর্যন্ত, শহর-গ্রামের এই বৈষম্য থাকতো না। স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ পেতো এবং এর সুফল ভোগ করতো প্রতিটি মানুষ। এছাড়াও সুবিচার নিশ্চিতের জন্য উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হতো আদালত। সমাজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থির থাকতো। ধর্ম-বর্ণ ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের কারণে নিপীড়িত মানুষেরা মুক্ত হতো শোষণ থেকে। ভূমি ব্যবস্থা সংষ্কারের মাধ্যমে তৎকালীন দেশের প্রায় অর্ধেক ভূমিহীন মানুষের মধ্যে তা বণ্টন করে সামাজিক সাম্য গঠনের উদ্যোগটি ছিল। উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধির জন্য সমবায়ভিত্তিক ও যন্ত্রনির্ভর আধুনিক কৃষিব্যবস্থা চালুর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন ছিল। কারখানা জাতীয়করণ এবং ভূমি ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের মাধ্যমে কোটা কোটি বাঙালির দুঃখী মুখে স্থায়ীভাবে সুখের হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জনের ধারণা মুজিববাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য
সংবিধানের চার নীতির মধ্যে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- প্রচলিত গণতন্ত্রের মারপ্যাঁচে দুর্নীতি, শোষণ, অবিচার, অত্যাচার ও প্রতারণার কারণে সমাজের ৯৫ ভাগ মানুষ তথা মেহনতি কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণ হবে। এজন্য আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। এজন্যেই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনো বিরোধ নেই।
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সহাবস্থানের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি যে চীন বা রাশিয়ার মতো, লেলিন-মার্কস-অ্যাঙ্গেলস বা মাও সে তুংয়ের মতো সমাজতন্ত্র চান না, সেটিও স্পষ্ট করেছেন। তিনি চেয়েছেন নিজস্ব স্টাইলের সমাজতন্ত্র, এটিকে তিনি শোষিতের গণতন্ত্র বলে অভিহিত করতেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে দেশজ ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণ যাদের নির্বাচন করবে, তারাই সরকার চালাবে। শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়। শক্তির উৎস হল জনগণ।’
শহর-গ্রাম মিলে দেশের ৯৫ ভাগ শোষিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে, নতুন সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধু। এটি ছিল তার জীবনের অন্যতম একটি লক্ষ্য। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়ে ওঠার কারণে ছোট থেকেই তিনি কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জীবনকে কাছে থেকে অনুভব করেছেন। তাই পাকিস্তানিদের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রায় জনমানুষকে ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলেছেন, মানুষও তার কথায় আস্থা রেখে অন্ধের মতো ভোট দিয়েছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশেলে বৈষম্যহীন যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন বঙ্গবন্ধু, এটাই মুজিববাদের অনন্য বৈশিষ্ট্য, এটা একদিনে হয়নি, এই ধারণা স্বাধীনতার প্রতিটি আন্দোলনে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। এই শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্যই বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো।’
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে উগ্রতার মূল তুলে ফেলে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গঠন
দেশভাগের আগে, লেখাপড়ার করার সময় একপর্যায়ে কলকাতায় ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব। মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ১৯৪৬ সালে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা কাছে থেকে দেখেছেন। এমনকি ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানিদের ভণ্ডামি, সামরিক একনায়কদের খামখেয়ালিপনা, শোষণের শিকার জনতার মুখে স্থায়ী দুঃখের ছাপ। একারণে ধর্মের অপব্যবহার রোধে রাজনীতি থেকে একে আলাদা করে রাখার ব্যাপারে সবসময় কথা বলতেন তিনি।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহারে এবং প্রতিটি জনসভায় ধর্ম-বর্ণ নির্বশেষে সম্প্রীতির রাষ্ট্র গড়ার কথা বলেছেন। পরবর্তীতে বাকশাল ঘোষণার সময়েও তিনি একে অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে রেখেছেন। বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতির বন্ধনকে ধর্মের অপব্যবহারের মাধ্যমে কেউ যেনো বিভক্ত করতে না পারে, সব ধর্মের লোক মিলে যেনো একটা শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলে, সেটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর দর্শন।
১৯৭৫ সালে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বরূপ বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সংসদে বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবো না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি- ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, অত্যাচার, খুন- এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না।’
জাতীয়তাবাদের চেতনায় একসূত্রে সাত কোটি বাঙালি
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনার মাধ্যমে ক্রমেই একটা জাতিকে তীব্র জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করেছেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেই তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম স্তম্ভ মনে করতেন। ভাষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে এবং বাংলার মানুষের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুজিববাদের অন্যতম লক্ষ্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে তাগিদ দেন। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিককরণে ভূমিকা রাখেন। এমনকি, ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজ অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন।
এদিকে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন, তিনি একে অভিহিত করেন ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ বলে। দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে এর প্রচারণা করেন। এসব কারণে তীব্রভাবে জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠে আপামর বাঙালির মনে। ছয় দফার কারণেই পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে প্রতিজ্ঞ হয় প্রতিটি মানুষ, স্বতন্ত্র ভূখন্ডের দাবি ওঠে। এরমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে আন্দোলন দমাতে চাইলো সামরিক জান্তরা। কিন্তু গণআন্দোলনের কারণে তাকে ছাড়তে বাধ্য হয় এবং পাকিস্তানি জান্তাদের প্রধান আইয়ুব খানকেও পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু মুক্তির নেশায় মগ্ন, তীব্র জাতীয়তাবোধে জাগ্রত, সাত কোটি বাঙালির মুক্তির দাবি আর থামেনি। যার ফলাফল, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে সরাসরি ২৬২ আসনের মধ্যে ২৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পরও ১৯৩ সালে সেই নৌকা প্রতীক নিয়েই ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে তার দল।
বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ একদিনের নয়, ছোট থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের দেখে জাতীয়তাবাদের বীজ রচিত হয়েছিল তার মনে। তিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে সেই বীজ বপন করেন পুরো জাতির মনে। যার চূড়ান্ত ফলাফল ৭০ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং পরবর্তীতে ৭ মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আদেশ দেওয়ার পর, প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের প্রতিটি ঘর দুর্গে পরিণত হওয়া।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দীর্ঘ পদযাত্রার সূচনা আসলে সেই বাল্যকালেই, যা পরিণত বয়সে তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। তিনি প্রভাবিত হয়েছেন নিজ এলাকার স্বদেশী আন্দোলনের নেতা অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাসের জীবন দেখে, এই নেতাকে নিয়ে লেখা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রভাবিত করেছিল কিশোর শেখ মুজিবকে। পরবর্তীতে সেই কবিতা থেকেই ‘জয় বাংলা’ শব্দটি স্বাধীনতার বীজমন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। এছাড়াও বাল্যকালে তার একজন গৃহশিক্ষক (হামিদ মাস্টার) ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা। এখান থেকেই সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিশোর শেখ মুজিব। পরবর্তীতে নিজে মিশেছেন মাঠে-ঘাটে সবশ্রেণির মানুষের সাথে। সময়েই পরিক্রমায় নিজেই হয়ে উঠেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র নেতা। বঙ্গভঙ্গর সময় যা করতে পারেনি ভারতবর্ষের নেতারা, ১৯৭১ সালে তাই করে দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। একটা জাতিকে জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত করে এনে দিয়েছেন স্বাধীনতা। তাই তিনি জানতেন, এই জাতীয়তাবাদই পারে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা জাতিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়া করাতে।
মুক্তির মন্ত্র
প্রকৃতপক্ষে, মুজিববাদ আসলে বাংলাদেশের পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবন থেকে অর্জন করা রাজনৈতিক দর্শন। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই তিনি সাত কোটি বাঙালিকে একত্র করেছিলেন, তাদের সক্রিয় করে দেশটাকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। দেশ স্বাধীনের পর, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীনতার সুফল সবার সবার পৌঁছে দিতে চেয়েছেন এই দর্শনকে কাজে লাগিয়েই। তাই মুজিববাদ আসলে আর কিছু নয়, মুজিববাদ মানে বাঙালির মুক্তির মন্ত্র।