নিউজ ডেস্ক:
উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর গত চার মাসে ‘মাতৃ ও পিতৃপরিচয়হীন’ সাড়ে আট লাখ ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। এর মধ্যে পথশিশু, ভবঘুরে, পরিচয়হীন, বেদে, যৌনকর্মী, পথবাসী ও ঠিকানাবিহীন অনেকেই রয়েছেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে এসব ব্যক্তিকে জন্ম নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
আগের নিয়মে মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন থাকলেই কেবল ২০০১ সাল ও তার পরে জন্ম নেওয়া সন্তানরা জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগ পেতেন। এ বাধ্যবাধকতার কারণে এতদিন জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে অনেককেই সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে, বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন থাকার বাধ্যবাধকতার কারণে সন্তানদের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে অনেকেই অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। আর যারা মাতৃ ও পিতৃপরিচয়হীন, তাদের জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আসতে নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সফটরওয়্যারে কোনো সুযোগই রাখা ছিল না। তবে মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন থাকার বাধ্যবাধকতা রাখার কারণ সম্পর্কে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, “জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি ‘পরিবারের নিবন্ধন বিন্যাস’ তৈরির জন্য এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। কারণ কেউ কেউ শিশুদের পছন্দের স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে একই সন্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে বয়স বাড়িয়ে বা কমিয়ে একাধিক জন্ম নিবন্ধন করিয়েছেন। পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন বাধ্যবাধকতা রাখলে এভাবে একই শিশুর একাধিক জন্ম নিবন্ধন করতে চাইলে বিষয়টি ধরা পড়ত।”
কিন্তু পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি শেষে গত ২০ জুলাই হাইকোর্ট সবার জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগ দিতে নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশনার পর গত ২৬ জুলাই মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন থাকার বাধ্যবাধকতা সফটওয়্যার থেকে তুলে সবাইকে জন্ম নিবন্ধনের সুযোগ করে দেয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভারের সফটওয়্যারে পরিবর্তন আনার পর থেকে সুযোগটি সৃষ্টি হয়।
এর পর গত ২১ নভেম্বর পর্যন্ত মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন তথ্য ছাড়াই ৩৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৫৭ জনের জন্ম নিবন্ধন করা হয়েছে। এর মধ্যে পিতা-মাতার ‘নামবিহীন’ জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৯৫ জনের, পিতা-মাতা ‘নেই’ এমন জন্ম নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৬৮টি, পিতা-মাতা ‘অজ্ঞাত’ এমন জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১১ হাজার ৯৪৯টি এবং পিতা-মাতা ‘অপ্রাপ্য’ এমন জন্ম নিবন্ধনের সংখ্যা ১৩০টি। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের কারও বাবা-মায়ের সন্ধান পাওয়া গেলে তা নিবন্ধন সনদে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদ।
তবে মা-বাবার পরিচয় ছাড়া নিবন্ধিত ব্যক্তিদের মধ্যে কতজন পথশিশু, ভবঘুরে বা অন্যরা রয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা বলা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত সারাদেশ এবং বিদেশি মিশনগুলোসহ ৫ হাজার ১৬০টি নিবন্ধক কার্যালয় থেকে জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু তথ্য ঘাটতি থাকলেও নিবন্ধন হয়। সবাই নিবন্ধন করতে পারছে। সে কারণে কতজনের মা-বাবার পরিচয় নেই, সে হিসাব যথাযথভাবে বলা সম্ভব না।
সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্ম নিবন্ধন বাধ্যবাধকতার করার যৌক্তিকতা সম্পর্কে রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বলেন, ‘পিতা-মাতার জন্ম নিবন্ধন বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছিল মানুষ যেন একটি নির্ভুল জন্ম সনদ পেতে পারে। এর ফলে সেবা গ্রহণে যেন কোনো ভোগান্তির মধ্যে না পড়তে হয় সেই জন্য করা হয়েছিল। এখন জনগণেরর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সফটওয়্যারে পরিবর্তন এনে এ বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হয়েছে।’
সহকারী রেজিস্ট্রার জেনারেল সামিউল ইসলাম রাহাদ আমাদের সময়কে জানান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০০৪ এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৮ অনুসারে দেশের পথশিশু, ভবঘুরেসহ সবার জন্ম সনদ পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেই অধিকার নিবন্ধন ব্যবস্থায় আগেও ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছে।’
নিবন্ধন বিধিতে ৮(ঙ) বলা হয়েছে, রাস্তায় বা উন্মুক্ত স্থানে জন্ম বা মৃত্যুর ক্ষেত্রে উক্ত রাস্তা বা উন্মুক্ত স্থান যে থানার অধীন সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জন্ম বা মৃত্যুর তথ্য প্রেরণ করবেন। আর নিবন্ধন আইনের ধারা ৪-এ নিবন্ধক ও নিবন্ধকের অধিক্ষেত্র সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। নিবন্ধক আইন ও বিধি মোতাবেক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন এবং অধিক্ষেত্রের সকল নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করবেন বলে জানান রাহাদ। তিনি বলেন, ‘কোনো নিবন্ধক যদি এই দায়িত্ব পালন করতে অবহেলা করে বা কাউকে বাবা-মায়ের নিবন্ধন বা অন্য কোনো তথ্যের অপ্রাপ্যতার জন্য নিবন্ধন না করে তাহলে তা হবে আইন ও বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও দ-নীয় অপরাধ।’
আদালতের নির্দেশনা পেয়ে পথশিশুসহ সব শ্রেণির মানুষ জন্ম নিবন্ধন করতে পারছে এ বিষয়ে হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলে জানান রাহাদ। পথশিশুদের জন্ম নিবন্ধনের সুযোগ চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছিল স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেন্ডেন্টস নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির আইনজীবী তাপস কান্তি বল আমাদের সময়কে বলেন, ‘রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল হয়েছে। তবে সেখানে নিবন্ধনের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে প্রকৃতপক্ষে সে সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। এখন এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। সেসব প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বোঝা যাবে সবাই নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছে কিনা।’