মা। একটি শব্দ। যার মধ্য দিয়ে অনুভব করা যায় পৃথিবীর সব রকম সুখ, ভাল লাগা ভালবাসা। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষাতেই একই রকম অনুভূতি এই শব্দটিতে। “
‘মা’ শুধুমাত্র একটি শব্দ এমন তো না। প্রিয় শব্দ, সুমধুর ডাক বা বিশেষ কিছু বিশেষণে ভূষিত করার মধ্য দিয়ে কি উপলদ্ধি করা যায়, মা কী, মা কে! অন্তরস্থ করার বিশাল এক ভান্ডার মা। যা মহাজাগতিকের উর্দ্ধে। মা’কে ভালোবাসার জন্য কোন বিশেষ দিনের প্রয়োজন নেই। তবুও পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য পুরো পৃথিবী জুড়ে পালন হয়ে আসছে বিশ্ব মা দিবস।
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী এ দিনটি পালিত হয়। তবে কোন কোন দেশে বা অঞ্চলে মা দিবস ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালন হয়ে থাকে। তবে এই মা দিবসের সূচনা আজকের মত এত জনপ্রিয় ছিল না। ছিল না আজকের মত বানিজ্যকরণ। বর্তমান কর্পোরেট যুগে সব কিছুতেই বানিজ্যের ছোঁয়া। তাতে আবেগ কতটুকু কাজ করে সেটি হয়ত জানা বা বোঝা যাবে না।
মায়েদের কোন বয়স হয় না। মায়েরা রুপকথার পরীদের মত একটি নিদিষ্ট বয়সে আটকে থাকে। তবে পৃথিবীর বুকে মা দিবসের বয়স বেশ পুরনো। মা দিবসকে প্রতিষ্ঠিত করতে করতে হয়েছে সংগ্রাম।
ইতিহাসের পেছন পাতায় আজও সে গল্প গুলো চকচকে। মা দিবসের সূচনা প্রাচীন গ্রিসের মাতৃরূপী দেবী সিবেলের আরাধনা, প্রাচীন রোমানে দেবী জুনোর আরাধনা ও ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে মাদারিং সানডের মতো বেশ ক’টি আচার-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। নিদিষ্ট একটি রোববারে পালন করা হতো মাদারিং সানডে যা মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য করা হতো। এটিকে মা দিবসের শুরুর ইতিহাস বলা যায়।
১৮৭০ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে নির্মমতার সীমা অতিক্রম করলে, সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ড হোই নামের এক নারী শান্তি প্রত্যাশায় একটি ঘোষণা পত্র লেখেন যেটিকে মাদার’স ডে প্রোক্লেমেশন বলা হয়। এ ঘোষণার মধ্যে জুলিয়া রাজনৈতিক স্তরে সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন।
যুদ্ধ শেষে পরিবারহীন অনাথদের সেবায় ও একত্রীকরণে নিয়োজিত হন আরেক মার্কিন সমাজকর্মী আনা রিভিজ জার্ভিস ও তার মেয়ে আনা মেরি জার্ভিস। এসময় তারা জুলিয়া ওয়ার্ড ঘোষিত মা দিবস পালন করতে শুরু করেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে আনা রিভিজ জার্ভিস ১৯০৫ সালের ৫ মে মারা যান।
মেরি জার্ভিস মায়ের শান্তি কামনায় ও তার সম্মানে মা দিবসকে সরকারী ভাবে পালনের জন্য প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। এর বছর তিনেক পর ১৯০৮ সালের ১০ মে মেরি জার্ভিস পশ্চিম ভার্জিনিয়ার অান্দ্রেউজ মেথডিস্ট এপিসকোপাল চার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মা দিবস পালন করেন। এপিসকোপাল চার্চটি এখন International Mother’s Day Shrine নামে পরিচিত।
আনা রিভিজ সাদা কারনেশন ফুল ভীষণ ভালোবাসতেন। তাই নিজের ও সব মায়ের সম্মানে চার্চে উপস্থিত সব মায়েদের দু’টি করে সাদা কারনেশন ফুল উপহার দেন অানা মেরি জার্ভিস।
কিন্তু এখানেই অানা মারি জার্ভিস থেমে ছিলেন না। ১৯১২ সালে তিনি স্থাপন করেন মাদার’স ডে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন। এসময় জার্ভিস মা দিবসকে ছুটির দিন করার লক্ষ্যে ও দিনটিকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে ব্যাপক প্রচারণা চালান। তার এই প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায়। তারপর ১৯১৪ সালে তার প্রচেষ্টা সফল হয়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস ও জাতীয় ছুটির দিন দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকেই সরকারিভাবে মা দিবস পালিত হতে থাকে।
কিন্তু মা দিবসের মূল বিষয়টি খেয় হারিয়ে বসে বাণিজ্যকরণের দাপটে। যেহেতু কারনেশন ফুল দেয়া হতো চার্চে উপস্থিত মায়েদের সম্মান করে সে কারণেই কারনেশন ফুল থেকে যেকোন ফুল বিক্রির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যায়। হাতে লেখা চিঠিত মায়েদের প্রতি যে আবেগ ছিল সে জায়গা নেয় প্রিন্টেন্ড বাহারি ডিজাইনের কার্ড।
এখন অবশ্য সে জায়গা নিয়েছে মুঠোফোনে বার্তা কিংবা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্ট্যাটাস। বছরে একটি দিন মায়েদের জন্য এমন আয়োজন কি আদতে সম্মান ভালোবাসা সৃষ্টি হয় মায়েদের প্রতি নাকি প্রতিটি দিনই মায়েদের প্রতি ভালোবাসার, সম্মানের।
মা দিবসকে বাণিজ্যকরণের মোড়কে নতুন রূপে দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না আনা মেরি জার্ভিস। ঘোর প্রতিবাদ করেন মা দিবসকে নিয়ে অবমাননার। নিজের সমস্ত সম্পত্তি ব্যয় করেন ও ঘোর বিরোধিতার অভিযোগে গ্রেফতার হন। আনা মেরি জার্ভিসকেই মা দিবসের আসল প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাতে মা’কে ডাকা যায়। কিন্তু সম্পর্ক একটাই মা-সন্তান। সন্তানের করোনা হলে কি মা ফেলে আসতেন। পত্রিকাতে প্রায় চোখে পড়ে যতটা তারচেয়েও বেশি অসহায় নির্যাতিত প্রতিটি মা। পরিশ্রমে মননে মায়েরা শান্তি খুঁজে যাচ্ছেন, বিলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের পরবর্তী প্রজম্মকে মায়েদের মত আরেকটি মা তৈরী করতে। মানব জীবনে বহুরপী চরিত্রে একজন নারীকে থাকতে হয় যার সার্থকতা পায় মা হয়ে।
যদিও মা’কে ভালোবাসার, সম্মানের জন্য বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। তারপরও মা বলতে না পারা কথা বলার সুযোগ করে দেয় দিবসটি।
খুব ভালোবাসি মা তোমাকে।
পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাস। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল মা, থাকুক হাসি মুখে।
লেখক: সাংস্কৃতিককর্মী, সংবাদকর্মী