নিউজ ডেস্ক:
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছেন সরকারের মন্ত্রীরা। এই ঘটনার কড়া সমালোচনা করে তারা দাবি করেছেন-যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কল্পনাপ্রসূত, একপেশে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো ধরনের পূর্ব যোগাযোগ ছাড়া হঠাৎ করে এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না।
রাজধানীতে পৃথক অনুষ্ঠানে রোববার মন্ত্রীরা এসব কথা বলেন। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে। অন্যদেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার আগে, যুক্তরাষ্ট্রকে নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের অনুরোধও জানান তারা।
সচিবালয়ের নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দ্বিপক্ষীয়, অভিন্ন ও বহুপক্ষীয় ইস্যুতে দুদেশ নিজ নিজ অবস্থানে থেকে কাজ করছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন লগ্নে যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত ও ব্যথিত। মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্ত একপেশে ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ সিদ্ধান্ত দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করবে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, এ সিদ্ধান্তের গভীরে বাংলাদেশবিরোধী কিছু ব্যক্তি ও অপশক্তির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বাংলাদেশের একটি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি তাদের এ নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশকে নিজেদের দাসত্বের রাজ্যে সমর্পিত হতে বাধ্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা বলে দেশের জনগণ মনে করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র অতীতেও কাজে আসেনি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শূন্য থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে অব্যাহত অগ্রযাত্রা তা অনেকেই মেনে নিতে পারছে না, তারা এ জনপদ নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে চায়। তিনি বলেন, প্যালেস্টাইনে ইসরাইল যখন নির্বিচারে নারী, শিশু হত্যাসহ শত শত ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, বোমা নিক্ষেপ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি ইসরাইলের পক্ষে থাকে, টুঁ শব্দটাও উচ্চারণ করে না।
সেতুমন্ত্রী বলেন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার সূচকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার কথা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বারবার উল্লেখ করেছে। খোদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিকে আমেরিকা সফরে বাধা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর কোনো কোনো খুনি এখনো আমেরিকায় লুকিয়ে আছে, যুদ্ধাপরাধীরাও সে দেশে পালিয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সিনেটর অব লেবার রবার্ট রেইচ এক টুইট বার্তায় বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, শুধু ২০২০ সালে সে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৯৮৪টি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬ হাজার ৬০০টি। প্রতিবছর দেশটিতে প্রায় এক হাজার মানুষ বিনা বিচারে মারা যায়। যাদের দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন বিভিন্ন শহরে রাস্তায় নামে, তাদের অন্যদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সচিবালয়ে তথ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে অধিদপ্তর প্রকাশিত ‘মা ও শিশু’ বিশেষ সাময়িকীর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক। উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে আমাদের উন্নয়নে সহযোগিতা করে আসছে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ দমনে দু’দেশের টেকনিক্যাল সহযোগিতায় আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপকৃত হয়েছে। কারণ সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক দমন করতে বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক প্রয়োজন। কিন্তু মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট যেভাবে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা অনভিপ্রেত, দুঃখজনক, অগ্রহণযোগ্য, অকার্যকর।
‘এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে’ উল্লেখ করে ড. হাছান বলেন, ‘মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটেছে কিনা বা বহু পূর্বে ঘটেছে কিনা সেটি আমার জানা নেই। কোনো পূর্ব যোগাযোগ ছাড়া হঠাৎ করে এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী হয়েছে কিনা সেটিও একটি বিষয়। আমরা আশা করব আমাদের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ‘সেন্টিমেন্ট’ অনুধাবন করতে সমর্থ হবে।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তাদের ওপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। কিন্তু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনকারী ইসরাইলের কোনো কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা যায়নি। অনেক উন্নত দেশে এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের সম্পর্ক যুক্ত সেখানে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে আমরা দেখিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য ও সম্প্র্রচারমন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। জর্জ ফ্লয়েডকে যেভাবে প্রকাশ্যে গলার ওপর পা দিয়ে চেপে ধরে হত্যা করা হয়েছে, এমন ঘটনা বাংলাদেশে কখনো ঘটেনি। মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রচণ্ডভাবে, ক্রমাগতভাবে বছরের পর বছর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এবং তাদের পুলিশি হেফাজতে যে মৃত্যু হয় সেগুলো নিয়ে, গুয়ান্তানামো বে’তে বন্দিদের ওপর নির্যাতন করে, বিশ্বব্যাপী সমালোচনা রয়েছে, সে দেশেও প্রতিবাদ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় অভিবাসীরা যখন বর্ডার ক্রস করার চেষ্টা করেছে, তখন তাদের ছেলেমেয়েদেরকে যেভাবে বছরের পর বছর মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, সেটি অন্য কোনো দেশে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এ নিয়েও বিশ্বব্যাপী এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রতিবাদ হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজদের ২৬তম জুডিশিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যারা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাস করে, তাদের একটা কর্তব্য থাকে, সেটা হচ্ছে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা এবং যাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাদের আত্মপক্ষ বক্তব্য শোনা। এটা দুঃখজনক যে, কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই এমন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে সব দোষে র্যাব বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে দোষী করা হয়েছে তা ঠিক নয় এবং এটা কল্পনাপ্রসূত। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের বিষয়ে আনিসুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি।’