সোমবার , ডিসেম্বর ২৩ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ হাস্যকর ও লজ্জাজনক

‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ হাস্যকর ও লজ্জাজনক

নিউজ ডেস্ক:

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বরাবরের মতোই অতি সম্প্রতি আরেকটি আজগুবি তত্ত্ব দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের ডেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে আপনাদের জানাতে চাই, কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গাইনাইজেশন (সিএইচআরআইও) গণতন্ত্রের প্রতি অসামান্য অবদানের জন্য ‘দেশনেত্রী’কে মাদার অব ডেমোক্রেসি অ্যাওয়ার্ড প্রদান করেছে ।” মির্জা ফখরুলের ঘোষণার পর বাংলা ভাষায় অতি প্রাচীন ও জনপ্রিয় একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ছে ‘আর কইয়েন না কত্তা, ঘোড়ায় শুনে হাসবে!’

কানাডার সেই সিএইচআরআইও-এর ওয়েবসাইটে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, অলাভজনক সংগঠন হিসেবে ২০০৩ সালের ১৩ ফেব্রয়ারি যাত্রা শুরু করে। এর সদর দপ্তর কানাডার অন্টারিওর টরন্টো। মানবাধিকার সুরক্ষা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সহায়তা করা সংগঠনটির লক্ষ্য বলে ওয়েবসাইটে বলা হয়। কানাডার বাইরে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর শাখা আছে।

সংগঠনটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এর এশিয়া মিশনের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মমিনুল হক (যিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের ভাগ্নে) এবং বাংলাদেশ মিশনের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা বেগম। এই দুজনের পরিচয় থেকেই বোঝা যায় সিএইচআইআরও সংগঠনটি কানাডার একটি ভুঁইফোড় সংগঠন। সংগঠনের এত বড় দুটি পদে যারা আছেন তারা কেউ বাংলাদেশের কোনো খ্যাতিমান মানবাধিকারকর্মী নন। এমনকি বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারাও তাদেরকে কেউ চিনবেন বলে মনে হয় না। আমাদের দেশেও এরকম শতশত ভুঁইফোড় সংগঠন আছে। যারা টাকার বিনিময়ে ক্রেস্ট কেনাবেচা করে।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, খালেদা জিয়াকে কেন কানাডা থেকে কোটি টাকা খরচ করে এই ভুঁইফোড় সংগঠন থেকে সনদ আনতে হলো? এবার একটু পেছনে তাকানো যাক।

২০১৫ সালে বিএনপির এক কর্মী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে সেটি প্রত্যাখ্যান হয়। তার আবেদনে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত অভিযোগ তুলে ‘বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে রায় দেয় কানাডার ফেডারেল কোর্ট। আদেশটি রিভিউ করা হলে ২০১৮ সালের ৪ মে দেশটির জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদনে ফেডারেল কোর্টের বিচারক জাস্টিস ব্রাউন বিএনপিকে দ্বিতীয়বার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে অভিহিত করেন। এরমধ্যে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যান।

দেশ-বিদেশে বিএনপি তখন চরম ইমেজ সংকটে পড়ে যায়, তখন বিএনপি হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে কোটি টাকা খরচ করে ভুঁইফোড় সংগঠন থেকে সনদটি কিনে নেয়। বিএনপি মহাসচিব বেগম জিয়াকে যে ক্রেস্টটি হস্তান্তর করেছে সেটির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় তারিখ লেখা আছে ৩১ জুলাই ২০১৮ সাল। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে কেন সাড়ে তিন বছর পুরস্কারের বিষয়টি গোপন রেখেছিল বিএনপি? বিএনপি ও তাদের নেত্রীর ইমেজ পুনরুদ্ধারে যে চেষ্টা করা হয়েছিল সেটি বুমেরাং হয়ে যাওয়ায় তারা এতদিন এটি গোপন রেখেছিল।

এবার দেখা যাক খালেদা জিয়াকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বলা কতটা যু্ক্তিসংগত। এক কথায় এটি পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছু নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার জন্য জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সমানভাবেই দায়ী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে।

তারপর ধাপে ধাপে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেন। ২৯ নভেম্বর ১৯৭৬ সেনাপ্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েমকে জোর করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন।

জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই এক সামরিক ফরমান জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা এবং আরেক ফরমান জারি করে ঘোষণা দেন তিনিই দেশের প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান একা ‘প্রেসিডেন্ট প্রার্থী’ হয়ে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোটের প্রহসনের নির্বাচন দেন। নিজের পক্ষে নিরানব্বই পার্সেন্ট ভোট হরণ করে জনগণের ভোটাধিকারকে কবর দেন।

বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্ট বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না হলে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে সামরিক বাহিনীতে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে চাকরিরত ছিলেন। সুতরাং, ‘হ্যাঁ-না’ ভোটে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ। আইনগতভাবে জিয়াউর রহমান ছিলেন অবৈধ রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান একই সঙ্গে সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি থাকার জন্য একটি সামরিক ফরমান জারি করেন।

১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি নিজে এই দলের নেতৃত্বে না থেকে উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে দায়িত্ব দেন। মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে জিয়া জাতীয়বাদী ফ্রন্ট ভেঙে দেন এবং ২৮ আগস্ট নিজেকে প্রধান করে বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দল (বিএনপি) নামে একটি দল গঠন করেন। তখনও জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান। একজন সেনাপ্রধানের নেতৃত্বেই জন্ম হয় বিএনপির। নিজের স্বার্থে তিনি বার বার দেশের সংবিধান, আইন-কানুন, সামরিক বাহিনীর বিধি বিধান ভঙ্গ করেছেন।

জিয়া-এরশাদের দীর্ঘ সামরিক স্বৈরশাসনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেখানেও বাধ সাধে জিয়াপত্নী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি তার স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে। মারাত্মকভাবে হোঁচট খায় দেশের গনতন্ত্র। বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৯টি আসন পায় বিএনপি। সংসদে একটি আসন পেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার স্বঘোষিত হত্যাকারী ফ্রিডম পার্টির সৈয়দ ফারুক রহমানকে বিরোধী নেতার চেয়ারে বসিয়ে সংসদকে অপবিত্র করে বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি মনোনীত স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরকে বাকি ১০টি আসন ছেড়ে দেয়া হয়।

তখন ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি ভোটারের মধ্যে বেশির ভাগই ভোট দেননি। নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ১০ শতাংশেরও কম ছিল।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে খালেদা জিয়া সরকার বিদায় নিলে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দুটি নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়ার পর ২০০৬ সালে আবার খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করলে আরেক দফা হোঁচট খায় গণতন্ত্র।

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নির্বাচনকে কলুষিত করার জন্য একটি বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন গঠন করে। একই সঙ্গে নিজেদের পছন্দের লোককে তত্ত্ববধায়ক সরকারের প্রধান করার লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি হিসেবে কে এম হাসানের বয়স বাড়ানো হয়, একজন ব্যক্তির জন্য সংবিধানও সংশোধন করা হয়। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ঘোষণা করে যে, কে এম হাসানকে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে মানবে না এবং এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন করবে না। পরিস্থিতি আরও নাজুক হলে বেগম জিয়া তার মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ।

তিনি একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি বিএনপির ইয়েসম্যানে পরিণত হন। বিএনপি নেত্রীর নির্দেশে সবকিছু করার প্রেক্ষিতে দেশের রাজনীতিতে এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের বিষয়ে অনড় থাকে বিএনপি-জামায়াত জোট। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিলে দেশকে সংঘাতময় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এগিয়ে আসে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিনকে সরিয়ে একটি অনির্বাচিত তত্তাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে দুবছরের জন্য গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে যায়।

বেগম খালেদা জিয়াই এদেশের গণতন্ত্রকে বার বার হত্যা করেছে। যখনই তিনি ক্ষমতায় গেছেন তখনই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে নানা রকম ফন্দিফিকির করেছেন। এরকম একজন গণতন্ত্র হত্যাকারীকে মাদার অব ডেমোক্রেসি বলাটা শুধু হাস্যকরই নয়, গণতন্ত্রের জন্য লজ্জাজনকও বটে।

লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

আরও দেখুন

সাড়ে ৪ মাস পর হিলিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে নিহত নাইমের লাশ কবর থেকে উত্তোলন

নিজস্ব প্রতিবেদক হিলি ,,,,,,,,,,,,,,,গত ৪ আগস্টে দিনাজপুরের হিলিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনেনিহত নাইমের লাশ প্রায় …