নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাগরতীরে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী। এ উপজেলার একটি ইউনিয়ন মাতারবাড়ি, যা মূল উপজেলা থেকেও বিচ্ছিন্ন। এখান থেকেই আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
গতি বাড়বে দেশের অর্থনীতিতে। অবশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগেই মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প আলো ছড়াতে শুরু করেছে দুর্গম অঞ্চলটিতে। প্রায় পাঁচ হাজার কর্মীর উপস্থিতিতে চলছে মহাযজ্ঞ।
বিদ্যুৎ প্রকল্পের মহাযজ্ঞের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে এখানকার জীবনযাত্রা। আগে যেখানে ছিল না কোনো সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাওয়া যেত না চায়ের দোকান। বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর সেখানেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য খাবার হোটেল। পিছিয়েপড়া অঞ্চলটির জীবনযাত্রায় লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি এই দ্বীপ অঞ্চলেই নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, যা মাতারবাড়ির উন্নয়নের গতি আরও বাড়ি দিয়েছে। একটা সময় কক্সবাজার থেকে দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে যেখানে যেতে হতো, সেখানেই এখন হবে চার লেনের রাস্তা। এছাড়া ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কল্যাণে কোটি টাকা খরচে বড় বড় রাস্তার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে।
সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্যানুযায়ী, মাতারবাড়ি ইউনিয়নের পূর্ব পাশে কোহেলীয়া নদী, উত্তরে উজান টিয়া নদী এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। অত্যন্ত দুর্গম মাতারবাড়ি ইউনিয়নে প্রায় ৮০ হাজার লোকের বসবাস। লবণ ও মাছ চাষ এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। এখানে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের চিত্র ভয়াবহ। শিক্ষা-দীক্ষায় দেশের অন্যান্য জনপদ থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে এই ইউনিয়নবাসী।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন এমন তথ্য দিলেও মাতারবাড়ি যে এখন আর উন্নয়নবঞ্চিত নয়, সে কথা জানান এই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ির উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছেন। এখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে। রাস্তাঘাটের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে এখানে এক কাপ চা পাওয়া যেত না, এখন আমাদের এখানকার বাসিন্দারা হোটেলে বসে আয়েশ করে কফি খায়। এর সবকিছুই হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর। সামনে আমাদের অঞ্চলে আরও অনেক উন্নয়ন হবে।’
দুর্গম অঞ্চলটিতে চলমান দুই মেগা প্রকল্পের মধ্যে ‘মাতারবাড়ি ২x৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন’ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। পাশাপাশি বাস্তবায়নাধীন এই দুই মেগা প্রকল্পের কিছু অংশ মাতারবাড়ির সঙ্গে ধলঘাটা ইউনিয়নেও পড়েছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ নিলে এ অঞ্চলে উন্নয়নযজ্ঞ শুরু হয়। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। পরিবেশ প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ) প্রতিবেদন অনুমোদন হয় পরের মাসে, অর্থাৎ অক্টোবরে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ প্রকল্প অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটা ইউনিয়নের ১৬০৫ একর জমির ওপর চলছে ১২০০ মেগাওয়াটের আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মহাযজ্ঞ। দেশের বাইরে থেকে জাহাজে প্রকল্পের মালামাল নিয়ে আসার জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি স্থায়ী জেটি, যেখানে সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রকল্পের কিছু মালামাল নিয়ে একটি জাহাজ ভিড়েছে, যা মাতারবাড়িতে আসা প্রথম জাহাজ। আরও একটি স্থায়ী জেটির কাজ চলমান। যে জেটির কাজে ব্যবহার হচ্ছে ২০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যামার।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লা পোড়ানোর জন্য দুটি বয়লারের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে এক নম্বর বয়লারের পাইলিং শেষ করে বেজমেন্ট ঢালাই দেয়া হয়েছে। দুই নম্বর বয়লারের পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বেজমেন্ট ঢালাইয়ের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। কয়লা পোড়ানোর ধোঁয়া যেন পরিবেশের কম ক্ষতি করে সেজন্য তৈরি করা হচ্ছে ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি। তবে এ চিমনি এখনো কাঠামোগত রূপ পায়নি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে ছাই তৈরি হবে তা মজুতের জন্য ২৫৫ হেক্টর জমিতে কূপ খনন করা হয়েছে। সেই কূপে পানি দেখা যায়। এই পানির নিচেই ২৫ বছর ধরে পোড়ানো কয়লার ছাই মজুত করে রাখা যাবে। সম্পূর্ণ দেশীয় উপায়ে ছাই মজুতের এ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এছাড়া কয়লা গুঁড়া করার কোলমিল, কনভেয়ার বেল্ট (কয়লা পাওয়ার প্লান্টে নিয়ে আসার বেল্ট), ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ওয়াটার প্ল্যান্ট, কেমিক্যাল লুজিং প্ল্যান্টসহ সবগুলো প্ল্যান্টের পাইলিংয়ের কাজ শেষের পথে। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস ও প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ৯৬ চাকার চালকবিহীন ট্রাক।
অন্যদিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এখনো শুরু হয়নি। অবশ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, আড়াইশ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর সমুদ্রবন্দরের চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের সীমানা ঘেঁষে সমুদ্রের পাড়ে চ্যানেলের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) আওতায় বাস্তবায়নাধীন এই বিদ্যুতের প্রকল্প ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইউনিট এবং ওই বছরের জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৬ সালের জুলাইয়ে ওয়ারেন্টি পিরিয়ড সমাপ্তির লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে কাজ চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা করপোরেশন ও আইএইচআই করপোরেশনের কনসোর্টিয়ামকে মাতারবাড়ি ২x৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ইপিসি ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের অধীনে ১৫টির অধিক সাব-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
মাতারবাড়িতে এই উন্নয়নযজ্ঞ যেভাবে শুরু হলো, তা ব্যাখ্যা করে আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে দায়িত্বরত শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে কয়লাগ লাগবে, তা আনার জন্য সার্ভে করেছিলাম। প্রাথমিক সার্ভে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকা- এ চারটা দেশের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিলাম। এই চারটা দেশ থেকে যে কয়লা আনা হবে, সেই সুবিধা নেই বাংলাদেশে। জাহাজগুলো কোথায় ভেড়ানো হবে? সেদিক বিবেচনা করে মাতারবাড়ির এই জায়গাটা নির্বাচন করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, আড়াইশ মিটার প্রস্থ এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে কয়লার জাহাজ আনা হবে। তারপর সরকার চিন্তা করল যে, আমরা তো একটা চ্যানেল তৈরি করেছি জাহাজ আনার জন্য। তাহলে কেন আমরা এটাকে সমুদ্রবন্দর করছি না? এভাবেই সমুদ্রবন্দরের ধারণাটা এসেছে।’
জানা গেছে, মাতারবাড়ির এ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে জাপান সরকার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) স্বল্প সুদে এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছে।
জাইকার একটি নথিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিদ্যুতায়ন ও শিল্পায়নের কারণে দ্রুত বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় অভ্যন্তরীণ গ্যাসের মাধ্যমে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ গ্যাসের মজুত দ্রুত কমছে এবং গৃহস্থালির কাজে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। আগামীতে বিদ্যুতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বাংলাদেশ সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মনোযোগী হয়।
সিপিজিসিবিএলের তথ্যমতে, ইতোমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকালে মালামাল আনার জন্য একটি অস্থায়ী চ্যানেল খনন করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও স্থায়ী গ্রামীণ জনপদের বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে চকোরিয়া-মাতারবাড়ি ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন ও মাতারবাড়ি ১৩২/৩৩ কেভি সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় যে চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে, তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে না সিপিজিসিবিএল। মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তাদের কাছে বন্দরটি ব্যবস্থাপনার জন্য হস্তান্তর করা হবে।
মাতারবাড়ি আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে কর্মীরা দিন-রাত কাজ করছেন। একটা সময় দেশি-বিদেশি পাঁচ হাজার কর্মী এখানে কাজ করেছেন। করোনার মধ্যেও কাজ থেমে থাকেনি। কাজ হয়েছে বলেই বন্দর চালু হয়েছে। কিছু কিছু কাজ শেষ হওয়ায় এখন কর্মীর সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এখন প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো কর্মী কাজ করছেন।’
তিনি বলেন, ‘এখানে যে প্রকল্পটি হচ্ছে এর পুরো সিস্টেমটাই নতুন। যে পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হচ্ছে তা অত্যাধুনিক। এটি জাপান সরকার করছে, কিন্তু জাপানেও এখন এটা বাস্তবায়ন হয়নি। এই প্রকল্পে যা কিছু আছে সবই অত্যাধুনিক। অনেক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনো দেখিনি। এর সবগুলো বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয়েছে এবং কাজ শেষে সবগুলো নিয়ে যাবে।’
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি-না এবং এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কত শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের সময় বাড়বে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ, এটা এক বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হবে। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
মাতারবাড়ির উন্নয়নের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশাপাশি মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর হবে। রাস্তার উন্নয়ন হবে। ইতোমধ্যে মাতারবাড়ির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে ওখানে একটা ফলের দোকানও ছিল না। চা পানের সুযোগ ছিল না। এখন ওখানে একটা বাজারেই অন্তত দেড়শ থেকে দুশ ফলের দোকান হয়েছে।’
অন্যদিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে যে কয়েকটি সমুদ্রবন্দর রয়েছে তার কোনোটিই গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। ফলে ডিপ ড্রাফটের ভেসেল এসব বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। ডিপ ড্রাফট ভেসেলের জেটি সুবিধা নিশ্চিতের লক্ষ্যে মাতারবাড়িতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক কনটেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যবাহী জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জেটিতে ভেড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ি ও মহেশখালী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলগুলোতে পণ্য পরিবহনে সহায়তা করাই এ বন্দর প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য।
জাইকার সার্ভে অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ সর্বোচ্চ দুই হাজার টিইইউএস কনটেইনার নিয়ে ভিড়তে পারে। অথচ পার্শ্ববর্তী কলম্বো, জওহরলাল নেহরু, করাচি ও চেন্নাই বন্দরে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ ভিড়তে পারে। এ বিবেচনায় মাতারবাড়িতে অধিক ড্রাফটের জাহাজের সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কনটেইনার পরিবহনে বাংলাদেশের জন্য উত্তম বিকল্প।
মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ৩০০ ও ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি টার্মিনাল থাকবে। এসব টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটের ৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের বেশি জাহাজ ভিড়তে পারে না। ফলে মাদার ভেসেলগুলো বন্দরের জেটিতে আসতে পারে না। ফলে ফিডার জাহাজে করে কনটেইনার আনা-নেয়া করতে হয়। প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৩৮০০ টিইইউএস আমদানি পণ্য কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে।
মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরে ১৬ মিটার গভীরতার জন্য মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ থাকায় একসঙ্গে আট হাজার কনটেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে মাতারবাড়ির এ বন্দর থেকে ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এসবের জন্য বন্দরে বহুমুখী টার্মিনাল (১১ দশমিক ৮ হেক্টর, ৩০০ মিটার জেটির দৈর্ঘ্য) এবং কনটেইনার টার্মিনাল (২০ দশমিক ২ হেক্টর, ৪৬৯ মিটার জেটির দৈর্ঘ্য) নির্মাণ করা হবে। প্রথমে দুই লেন এবং সর্বশেষ চার লেনের ২৬ দশমিক ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হবে বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অংশের প্রকল্প পরিচালক মীর জাহিদ হাসান বলেন, ‘এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি এই মুহূর্তে শতাংশে বলা যাবে না। বন্দরের কাজটা তিনটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে প্রকল্পটি কনসালট্যান্টরা ডিজাইন করবে, মানে ওখানে যে অবকাঠামোগুলো হবে সেগুলোর নকশা প্রণয়ন করবে তারা।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় ভাগে দরপত্র আহ্বান করা হবে। তৃতীয় ভাগে মূল অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এ বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের নকশা তৈরির কাজই চলবে। কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর। তারা কাজ শুরু করেছে ২ নভেম্বর থেকে।’
তিনি জানান, মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে জাপানের নিপ্পন কোই’র নেতৃত্বে মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে রয়েছে নিপ্পন কোইসহ জাপানের তিনটি এবং বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের দুটি হলো নিপ্পন কোই বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্টস এবং ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট (ডিডিসি)।
মীর জাহিদ হাসান বলেন, ‘এই পাঁচ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ২৩৪ কোটি টাকার পরামর্শক চুক্তি হয়েছে। তারা ডিজাইন-ড্রয়িং করবে, টেন্ডারের কাজ করবে, যখন অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে সেটা সুপারভিশন মনিটরিংও করবে তারা। মানে ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত তারা কাজ করবে।’
২০২২ সালের শেষ দিকে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হবে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘ডিজাইন হলে এর ভিত্তিতে টেন্ডার ডকুমেন্ট প্রস্তুত করা হবে। তারপর দরপত্র আহ্বান হবে, সেগুলো মূল্যায়ন হবে, চুক্তি হবে। এসব শেষ করে ২০২২ সালের জুলাই থেকে আশা করছি মাঠে কাজ শুরু হবে। ওই বছরের শেষ দিকে হয়তো আমাদের কাজ দৃশ্যমান হতে শুরু করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার চ্যানেল খনন করা হয়েছে। যার গভীরতা সাড়ে ১৮ মিটার এবং চওড়া আড়াইশ মিটার। আমাদের প্রকল্পের আওতায় আরও ১০০ মিটার বাড়িয়ে মোট সাড়ে তিনশ মিটার চওড়া করা হবে। আমরা ১০০ মিটার বাড়াব, এটাও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় হবে। মানে আমাদের সঙ্গে তাদের একটা চুক্তি আছে। এই ১০০ মিটার ওদের কন্ট্রাক্টর দিয়েই করানো হবে। পরে তারা আমাদের কাছে চ্যানেলটা হস্তান্তর করবে।’