সুরজিত সরকার:
আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জি, ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজেউঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধূলির সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আহ্বান আজ। মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে উচ্চারিত দেবী আহ্বান শোনা দিয়ে আজকের দিন শুরু। কারণ আজ যে মহালয়া।
শারদীয় দুর্গা পূজার জন্য সারা বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয় মহালয়তে এসে। পিতৃপক্ষের শেষ আর মাতৃপক্ষের শুরু। উৎসবে মেতে উঠেন সবাই। তার আগেই প্রকৃতি জানান দেয় নীল আকাশ, কাশফুল, শিউলি সবই যেন ঘরের মেয়ে উমার জন্য।
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র (৪ অগস্ট, ১৯০৫ – ৩ নভেম্বর, ১৯৯১) বাঙ্গালীর কাছে এক আবেগের নাম। ছোটবেলা থেকেই দুর্গা পুজার শুরুটা সকলের কাছে খুব আনন্দের। মহালয়া দিয়েই মূলত দুর্গাপুজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু। ভোররাত চারটা থেকে আকাশ বাণীতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডিপাঠ শুনলেই মনে হতো দুর্গাপুজা শুরু হয়েছে। যা বিজয়া দশমী দিয়ে শেষ হতো। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গা যেদিন মর্ত্যলোকে আগমন করেন, সেই আগমনী বা আহ্বানকে বলা হয় মহালয়া। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঢাক বাজিয়ে, শঙ্খের ধ্বনি ও চণ্ডিপাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে এদিন মর্ত্যলোকে স্বাগতম জানানো হয়। দেবী দুর্গার মর্ত্যলোকে আগমনের ষষ্ঠ দিনে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক দুর্গাপূজা। আর বিজয় দশমীতে দেবী দুর্গা আবার মর্ত্যলোক ছেড়ে কৈলাশে ফিরে যান। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শব্দটির সমার্থক অর্থ কবে থেকে যে ‘মহালয়া’ হয়ে গেছে বাঙালির জন্য তা স্মরণ করা কষ্ট সাধ্য।
সেই ১৯৩১ সালে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত একটি প্রভাতী সঙ্গীতালেখ্য কিভাবে যে একটি জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্য ও লোকাচারের পরিণত হয়েছে তা ভাবতে গেলে বিস্মিয় পিছু ছাড়বে না। আরও অবাক করা বিষয় ২০১৮ সালে এসে যখন আকাশ সংস্কৃতিতে ছেয়ে গেছে পুরো বিশ্ব তখন কেমন করে প্রায় নয় দশক ধরে একটি অনুষ্ঠান কিভাবে একটি জাতিসত্তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। শুধু তাই নয় অগ্রগতির চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও যুগে যখন মানুষের চিন্তা চেতনা ও রুচিবোধের বিস্তর প্রভেদ ঘটে গেছে তখনও সেই প্রাচীন যন্ত্রে রেকর্ডিং করা একটি আলেখ্যের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রমুখ আকাশবাণীর কর্তাদের উৎসাহে বাণীকুমার যে প্রাথমিক আলেখ্য রচনা করলেন তাতে সুর দিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। কলকাতার প্রায় সকল গায়ক-গায়িকা ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী অংশ নিলেন। সংলাপ ও স্তোত্র পাঠ করার গুরুদায়িত্ব নিলেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র । বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের অন্যান্য কাজ সম্পর্কে খুব একটা সকলে জানেন না এটি এক রকম হলফ করেই বেলা যায়। সে হিসেবে তাঁরা সময়ের গহব্বরে হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃত শিল্পী। তাদের অন্যকাজগুলিও জনসাধারণের মনে নেই। তবুও একটি অনুষ্ঠান বছরে একটি মাত্রদিন একবারের জন্য প্রচারিত হয়েও তাদের সর্বকালীন জনপ্রিয় শিল্পীর মর্যাদার আসীন করেছে। কারণ একটিই বাঙ্গালীর আবেগ। মহালয়া ও বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র আজ শুধু একটি অনুষ্ঠানই নয় কিংবা একজন শিল্পীর শিল্পের সঙ্গে মিলিত হওয়া নয় এটি এখন সারা পৃথিবীর বাঙ্গালীর আবেগ। সারা বিশ্বে এই ঘটনার নজির নেই | সেই বিশ্ময়কর রহস্যের মূল কথাটি খুঁজে বের করা মুশকিল। কাজটির প্রতি প্রত্যেকটি শিল্পীর সৎ চেষ্টা আন্তরিকতা ও দলগত কাজ করার মানসিকতা, সঠিক পরিচালনা ও উৎসাহে সঙ্গীত আলেখ্যটিকে কালজয়ী করে তুলেছে |
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ভাষ্য ও চণ্ডিপাঠ ও শ্লোকপাঠ শুনলেই মনে হয় দুর্গাপুজা এসে গেছে। কে এই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র? পঙ্কজকুমার মল্লিক ও কাজী নজরুল ইসলামের সমসাময়িক বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। ১৯৩০ সালে তিনি আকাশবাণীতে যোগ দেন। তারপর থেকে প্রতিবছর মহালয়া’র এই অনুষ্ঠানটি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। আজও দুর্গাপূজার সূচনায় মহালয়ার দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটির রেকর্ড আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হয়। এই অনুষ্ঠানটি এতটাই জনপ্রিয় যে, একবার ১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে জনপ্রিয় অভিনেতা উত্তম কুমারকে দিয়ে অন্য একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলে, তা জনমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। পরবর্তীতে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষকে সেই অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মূল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটিই সম্প্রচারিত করতে হয়েছিল।
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র একাধিক নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার কাজও করেন। ১৯৫৫ সালে নিষিদ্ধ ফল নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছিলেন তিনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। যে নদীর ঘাটে আগের বছর বির্সজন দিয়ে ফিরে আসা একটি বছরের প্রতীক্ষা নিয়ে সেই ঘাটেই পিতৃ তর্পনের মাধ্যমে দেবীর আগমনী। দেবী নদীর কোল থেকে বেরিয়ে আসেন যে নদীর কোলে ফিরে যান। বুকের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আগমনীর কোন এক হারানো সুর বার বার ফিরে আসে শরতের শিশির ভেজা শিউলি হয়ে ফিরে আসে আশ্বিনের শারদ প্রাতে। মহালয়া যে কি পরিমাণ নষ্টালজিক ব্যাপার সেটা বোধ হয় বাঙালি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। এই নষ্টালজিয়া বেঁচে থাক অনন্তকাল।
আরও দেখুন
বাড়ির উঠানে ৪ কেজি ওজনের গাঁজারগাছ-গ্রেপ্তার ১
নিজস্ব প্রতিবেদক সিংড়া,,,,,,,,,,,,নাটোরের সিংড়া পৌরসভার বালুয়াবাসুয়া মোল্লা পাড়া এলাকায় ১০ফুট উচ্চতার একটি গাঁজার গাছ উদ্ধার …