১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহানায়কের বেশে ফিরে এলেন। বাঙালির ইতিহাসে হাজার বছরের মধ্যে এমন বড় নেতার জন্ম হয়নি।
যার কথায়- সাত কোটি মানুষ জীবন বাজি ধরতে একটুও ভাবেনি। যার কথায় লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, অকাতরে জীবন দিয়েছে। এমন মহাকাব্যিক যুদ্ধ বিশ্ব কখনো দেখেনি। ১২শ’ বছরের ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বাঙালি কখনো শাসন কার্য চালায়নি। শাসিত হয়েছে। এই প্রথম বাঙালি শাসনকার্য চালাচ্ছে। বাংলায় সংবিধান রচিত হয়েছে। বাঙালি জাতি একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পেয়েছে। এর পুরোটাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন। তখন দেশভাগ সবাই মেনে নিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুও কোনো উপায় না দেখে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু একটা ষড়যন্ত্র যে হচ্ছে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মনের মধ্য থেকে তো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান হারিয়ে যায়নি। মনের ভেতর থেকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি গানটি হারিয়ে যায়নি। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে- ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে দেশ ভাগ হলো। মাত্র সাত মাসের মাথায় ৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। শেখ মুজিবুর রহমান সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। সেই বছরই মুসলীম লীগ থেকে বের হয়ে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠন করলেন। এর কিছুদিনের ভেতরই মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করলেন। ওই বছরই ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। ফিরে এসে আবার গ্রেফতার হলেন। বায়ান্নতে তিনি ভাষার পক্ষে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদকে সমর্থন দিলেন। এরপর তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। তিনি জেল থেকেই ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্যে একটা চিরকুট দিলেন। যার ভিত্তিতে ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি আনেন। এর পেছনে আরো অনেকেরই অবদান ছিল। বায়ান্নর পরে বঙ্গবন্ধুকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যে সিদ্ধান্তগুলো আশৈশব তিনি নিয়েছেন তার মধ্যে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছেন সেগুলোর আলোকে একটি ভিন্ন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। এরই ফল ’৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের অভাবিত জয়। এতে আরো একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল- বাঙালির সমর্থন, আওয়ামী লীগের চিন্তার প্রতি জনগণের সমর্থন আছে। এই সমর্থন তাকে দীপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিল। এরপর ’৫৬-’৫৭-এর রাজনৈতিক কোলাহল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাঙ্গামা, বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটকানো। শেষে জেল থেকে বের হয়ে নির্বাচন করে জয়ী হলে মন্ত্রিত্ব পেলেন বঙ্গবন্ধু। এসব ঘটনা একটি-আরেকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এবার আসি দ্বন্দ্বের শুরুর কথায়।
১৯৫৬ সাল পর্যন্ত আমরা পূর্ব বাংলা হিসেবে পরিচিত। হঠাৎ করে পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব করা হলো- এটিকে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা মহা ঘোরতর অন্যায় হবে। ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। দেশ ভাগ হওয়ার কারণে এটি পূর্ব বাংলা করা হয়েছে; এটি পূর্ব বাংলাই থাকবে। যদি পাকিস্তানের প্রদেশ হিসেবে নাম পরিবর্তন করা হয় তাহলে এটি হবে মহা অন্যায়। যদি পরিবর্তন করতে হয় তবে এটির নাম ‘বাংলাদেশ’ করতে হবে। এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতার মুখে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারিত হলো। এর আগেও ‘বাংলাদেশ’ শব্দ রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কাছে শুনেছি। সেগুলো ছিল সংস্কৃতিক আকাক্সক্ষা। কিন্তু একজন রাজনৈতিক নেতার মুখে, দেশের নাম করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে উচ্চারণ এই প্রথম। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হলো এবং বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার করা হলো। ’৬৮ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি গণআন্দোলন শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুসহ অনেক সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের জড়িয়ে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা করা হলো। বঙ্গবন্ধুকে তখন ক্যান্টনমেন্টে রাখা হলো এবং প্রচার করা হলো তাকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হবে। এরমধ্যেও তিনি অনমনীয় ছিলেন। মনোবল কতটা শক্ত হলে একজন নেতা এমন সময়েও দৃঢ় থাকতে পারেন।
১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্যারলে মুক্তি দিয়ে আইয়ুব খান লাহোরে একটি গোলটেবিল বৈঠকে আহ্বান জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাতে রাজি হননি। বললেন, ‘আমাকে মুক্তি দিতে হবে।’ এরপর তাকে মুক্তি দেয়া হলো। তিনি লাহোরের গোলটেবিলে যোগ দিলেন। সেখানে নির্বাচনের দাবি তুললেন। এই যে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা। জনগণের হয়ে কথা বলার প্রবণতা এসবই বঙ্গবন্ধুকে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এরপরই তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেন। জাতিকে প্রস্তুত করলেন। বাংলাদেশের একটি সম্ভাব্য কাঠামো তখনই একটু একটু করে স্পষ্ট হতে শুরু করল। অনেকের মুখে তখন থেকেই শোনা যাচ্ছিল- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’। সে বছরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া অনুষ্ঠানে তোফায়েল আহমেদের মুখে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করা হলো। মুহূর্তের মধ্যে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে বারবার ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি আসতে থাকল। সব অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা…’ সঙ্গীতটি গাওয়া হতো। তিনি নিজেও বক্তব্যের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্বৃতি করতেন। সামগ্রিকভাবে তার কল্পনা, স্বপ্ন, অভিপ্রায় এবং নিষ্ঠা মানুষের সামনে স্পষ্ট হতে থাকল। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর তিনি ১৯৭১-এর জানুয়ারি মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) শপথ নেয়ার ব্যবস্থা করলেন।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক সব পার্লামেন্ট মেম্বার শপথ নিলেন। লাখ লাখ মানুষ হাজির ছিলেন। আসলে প্রতিটি মানুষের ভেতরই আলাদা একটা রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা ছিল দীর্ঘদিনের। যা শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে বাস্তবায়িত হলো। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো অনেক ঘটনাই ঘটল। প্রতিদিনই একেকটি ইতিহাস জন্ম দেয়া ঘটনার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল বলা চলে। আমি উল্লেখ করতে চাই ৭ মার্চের সেই যুগান্তকারী বক্তব্যের কথা। বিশ্বের ইতিহাসের যদি তিনটি বক্তব্যের কথাও উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম সেই ৭ মার্চের বক্তব্য। এই বক্তব্যের মধ্যেই পুরো যুদ্ধের দিক-নির্দেশনা ছিল। ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে তৈরি থাকতে হবে’, ‘আমি যদি হুকুম নাও দিতে পারি, ‘রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দিবে’। প্রতিটি বাক্যেই একেকটা দিক-নির্দেশনা ছিল। গেরিলা কৌশল, যুদ্ধ নির্দেশনা থেকে শুরু করে সমস্ত নির্দেশনা ওই এক বক্তব্যেই তিনি দিয়ে রেখেছিলেন। এবং শেষে বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ শেষ বাক্যে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিকল্পনার পূর্ণতা দিলেন।
যা সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জনগণ কিন্তু সেই বক্তব্য অনুযায়ী ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা শুরু করল। প্রথমে তো আমাদের দা-কাঁচি, বাঁশের লাঠি, পাথর আর ইপিআরের অল্প সংখ্যক বাঙালি সদস্য দিয়েই যুদ্ধ শুরু করতে হয়েছে। আমাদের নারীরাও যুদ্ধ করেছে। পরে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়ায়। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দেয়। ওই সময়ে আমাদের একটি গান খুব প্রেরণা জুগিয়েছিল- ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি… বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ এই গানটি বাঙালি জাতিকে পুরো ৯ মাস জাগিয়ে রেখেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছেন কিন্তু লক্ষ মুজিব রয়েছে। এই কথাটি ভীষণ শক্তি জুগিয়েছে। বজ্রকণ্ঠের সেই বক্তব্য, জয় বাংলা স্লোগান ও আমার সোনার বাংলা প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আকাশ বাণী থেকে প্রচার করা হতো।
সেটি-ই মূলত এ দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। সেটি-ই মুক্তিযোদ্ধাদের অকাতরে জীবন উৎসর্গ করার সাহস জুগিয়েছিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। যারা এর ব্যাত্যয় করে; তারা ইতিহাসের বরখেলাপ করে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। আমাকেও প্রশ্ন করা হয়, কেন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম? আমি বলব- দু’জনের জন্য যুদ্ধ করেছি। একজন হলেন আমার মা, আরেকজন শেখ মুজিবুর রহমান। এ জন্য ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাঙালির মুখে হাসি ছিল না। তারা বঙ্গবন্ধুকে ফেরত চায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান হতো, যাত্রা হতো, গ্রামে গ্রামে পালাগান হতো। শরণার্থী ক্যাম্প, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে গান-বাজনা, পালা হচ্ছে, কবিতা আবৃতি হচ্ছে; সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। আমাদের মা-বোনরা তখন মুজিবের নামে মান্নত করে রোজা রাখতেন, হিন্দু মা-বোনরা উপোশ থাকতেন। ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত টানা রোজা-উপোস করেছেন বাঙালি নারীরা। একটা জাতি লড়াই করে বিজয় লাভ করার পরও বলছে মুজিব ছাড়া এ স্বাধীনতা অর্থহীন। আমরা মুজিবকে চাই। তাকে ফিরিয়ে দাও। বিশ্বশক্তি তখন বাধ্য হলো পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দিতে।
লেখকঃ মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে খ্যাতি রয়েছে। তিনি ঢাকা থিয়েটার ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলামঞ্চে উল্লেখযোগ্য অনেক নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি, যা নাট্যে বা থিয়েটারে তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এজন্য তাকে মঞ্চের কান্ডারি বলে ডাকা হয়। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র একাত্তরের যীশু। ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্র পরিচালনা করে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।