- দিনের আলোতে জ্বলবে রাতের বাতি
রশিদ মামুন ॥ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র মেঘনার মোহনায় জেগে ওঠা মনপুরা হচ্ছে দেশের প্রথম সূর্য দ্বীপ। এখানে রাতের সব বাতিই জ্বলবে দিনের সূর্যের আলোতে। শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনপুরায় বিদ্যুত সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য মনপুরায় তিনটি মিনি গ্রিডের সঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি তিন মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র। দিনের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে রাতের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাটারি চার্জ করে রাখা হবে।
বিদ্যুতের আলো জ্বলে ওঠাতে উপকূলের জীবনে বছর কয়েক আগেই লেগেছিল উন্নয়নের ছোঁয়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানে বিদ্যুতের স্পর্শ জাদুর কাঠির মতোই কাজ করেছে। উপকূলের এই উন্নয়নের ছোঁয়া পর্যটন শিল্পেরও ব্যাপক প্রসারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এবার মনপুরাতে যা আরও বিস্তৃত হওয়ার আশা জাগাচ্ছে। মনপুরাতে দুই হাজার ৫০০ গ্রাহককে সোলার মিনি গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুত বিতরণ করা হচ্ছিল। এর বাইরে সেখানে আরও ৮৫৩ জন গ্রাহক রয়েছে। সব মিলিয়ে তিন হাজার ৩৫৩ জন গ্রাহক সার্বক্ষণিক বিদ্যুত পাবেন। যার পুরোটাই আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেই চলবে মনপুরা।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুতের সংস্থান নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে। দেশেও ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার ঘটছে। তবে বিদ্যুতের মূল্য বিবেচনাতে এখনই শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনকে সমর্থন করেন না অনেকে। তবে উপকূলীয় এলাকার বায়ুর গতিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করা গেলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যাপক সম্প্রসারণ সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
ভোলা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে মনপুরার অবস্থান। তিন দিকে মেঘনার মোহনা এক দিবে বঙ্গোপসাগর। অতিপ্রাচীন এই দ্বীপটির রয়েছে ৬০০ বছরের ইতিহাস। তবে এই ৬০০ বছরের মধ্যে সেখানে বিদ্যুত পৌঁছানোর ইতিহাস খুব পুরাতন নয়। মাত্র কয়েক বছর আগে তিনটি সোলার মিনি গ্রিড নির্মাণ করা হয়। এই মিনি গ্রিড থেকে ৬৭৫ কিলোওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত বিদ্যুত দিয়ে আড়াই হাজার মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয়। গ্রাহক পর্যায়ে যে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে একই ধরনের গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি চার টাকার নিচে। গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত থাকা গ্রাহক এই সুবিধা পেলেও পাচ্ছে না অবহেলিত মনপুরার বাসিন্দারা।
কৃষি আর মৎস্যজীবী মানুষগুলো বেশি দামে হলেও এই বিদ্যুত কিনে আধুনিক স্রোতের সঙ্গে নিজেদের শামিল করছে। অবহেলিত এই জনপদের চোখে এখন দেশের মূলধারায় মিলে-মিশে একাকার হওয়ার স্বপ্ন জেগেছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এই উদ্যোগ নিয়েছে।
কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোঃ শফিক উদ্দিন বলেন, আমরা মনপুরাতে একটি তিন মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি। আইপিপি মডেলে নির্মাণ হওয়া কেন্দ্র থেকে আমরা সব বিদ্যুত কিনে নিয়ে দ্বীপবাসীর মধ্যে বিতরণ করব।
পিডিবি সূত্র বলছে, শুরুতে কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য হাইব্রিড প্রথা অনুসরণ করার কথা ছিল। এতে দিনে সৌর বিদ্যুত আর রাতে ডিজেল দিয়ে দ্বীপের চাহিদা মেটানোর কথা ছিল। তবে পিডিবি মনে করছে ডিজেলের পরিবর্তে রাতেও ব্যটারিতে বিদ্যুত ধরে রাখা সম্ভব। এখন লিথিয়াম আয়োন ব্যাটারির মাধ্যমে খুব কম সময়ে বেশি বিদ্যুত চার্জ করা সম্ভব। লিথিয়াম আয়োন ব্যাটারির এই প্রযুক্তিই ভোলায় ব্যবহার করা হবে।
মনপুরার বিদ্যুতের দামও কমিয়ে আনার চিন্তা করছে সরকার। মিনি গ্রিড এবং তিন মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুত পাওয়া যাবে তার পুরোটাই কিনে নেবে ওজোপাডিকো। আর ওজোপাডিকো যেহেতু বিদ্যুত বিতরণ করতে তাই এর দামও আলাদা হবে। তবে উচ্চ মূল্যের এই বিদ্যুতের দাম কি হবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নির্ধারিত দামেই এই বিদ্যুত বিতরণ করা হবে না অন্য কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দ্বীপটির মানুষকে আর ৩৫/৪০ টাকা দরের উচ্চ মূল্যের বিদ্যুত কিনতে হবে না। এজন্য সরকারের তরফ থেকে ভর্তুকি দেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। অর্থাৎ নির্ধারিত দামের বাইরে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বিদ্যুত কেনার অতিরিক্ত অর্থ ভর্তুকি দেবে সরকার। ওজোপাডিকো সূত্র বলছে, ওয়েস্টার্ন রিনিউবেল এ্যানার্জি (ডব্লিউআরইএন) আইপিপিভিত্তিক সোলার বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। এজন্য তারা প্রাথমিকভাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২৭ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। তবে এটি এখন পিডিবির ট্যারিফ নেগোসিয়েশন কমিটিতে রয়েছে। এখানে দরকষাকষির মাধ্যমেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে। সাধারণ সৌর বিদ্যুত কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে। তবে ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুত সংরক্ষণ করতে হলে এই দাম আরও কিছুটা বাড়বে।