নিউজ ডেস্ক:
দেশে ভোজ্যতেলের শতকরা ৯০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হয়। বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তেলের আমদানি কমিয়ে স্ব^য়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানির লাগাম টানা হবে। ইতোমধ্যে তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি- নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সরিষার ব্যাপক উৎপাদন বেড়েছে।
সারাদেশে গতবছর ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টরের তুলনায় এবার সরিষা আবাদ হয়েছে ৬ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন পৌঁছে যাবে ৯ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টনে। যা গতবছর ছিল ৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে সাড়ে ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষাবাদ করা হবে। একই সময়ে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ লাখ মেট্রিক টন।
এ বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা চাষে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। ৭০ হাজার বিঘা জমিতে সূর্যমুখী, ২৬ হাজার বিঘা জমিতে চিনাবাদাম এবং ২৪ হাজার বিঘা জমিতে সয়াবিন চাষে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। সবমিলিয়ে লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ১১ লাখ মেট্রিক টন তেল উৎপাদন।
তবে উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধান উৎপাদনের কোনো ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে না। আমন ও বোরো ধানের মাঝের সময়টাতে সরিষা চাষ করা হচ্ছে। এতে দুই ফসলের বদলে তিন ফসল পাচ্ছে কৃষকরা। সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে উচ্চ ফলনশীল বীজ সরবরাহ করায় সরিষায় আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা।
বাড়তি দাম পাওয়ায় দুই ফসলি জমিগুলো তিন ফসলি জমিতে পরিণত হচ্ছে। আর নতুন জাতের ধানের বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। যাতে করে ১২০ দিনের বদলে ৯০ দিনের মধ্যেই ফসল কাটা যাচ্ছে। এভাবে প্রযুক্তির সহায়তায় আমন ও বোরোর পাশাপাশি সরিষার উৎপাদন সময়ও কমিয়ে আনা হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ধূল্ল্যা ও জান্না গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে রাস্তার দু’পাশে সরিষার ফুলে হলুদ হয়ে আছে ফসলের খেতগুলো। স্থানীয় কৃষক আব্দুল গফুর বলেন, গত ২০ বছর ধরে এ এলাকায় সরিষা চাষ হয়নি। তবে এখন নতুন জাতের আমন-৭৫ বীজ সরবরাহ করছে সরকার। ফলে কম সময়ের মধ্যে ধান কাটা যাচ্ছে।
আর এরপরেই উচ্চ ফলনশীল সরিষার চাষ করা যাচ্ছে। পরে আবার একই জমিতে আমন চাষ করা হচ্ছে। কৃষক আবু তাহের বলেন, আগে আমরা বোরো ২৯ চাষ করতাম। এখন বিনা-৭৫ জাতের বীজ দিয়ে চাষাবাদ করছি। ফলে দ্রুত ধান কাটার পর পতিত সময়ে সরিষা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে।
মানিকগঞ্জের জেলা কৃষি উপ-পরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ বলেন, গতবছর জেলায় ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছিল। এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা। তবে ইতোমধ্যে প্রায় ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ২৫ শতাংশ জমিতে নতুন করে সরিষা চাষ হয়েছে।
সেখানে উৎপাদন প্রায় ৩৭ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি। ফলে গতবারের তুলনায় উৎপাদন বাড়বে প্রায় ৮৬০ মেট্রিক টন। খৈল থেকে প্রায় ৩৭০ হাজার লিটার সরিষার তেল পাওয়া যাবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। একইসঙ্গে দুই কোটি টাকার খৈল জাতীয় দ্রব্য পাওয়া যাবে।
আরেক কৃষক সোহরাব আলী বলেন, আমাদের বীজ দেওয়া হচ্ছে তবে বিনামূল্যে সার দিলে আরও উপকার হতো। সেচ দিতে প্রতিবছর ড্রেন করতে খরচ হয়। সেখানে সরকার পাকা ড্রেন করে দিলে তাদের উপকার হতো। এ সময় আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান এ কৃষক। এ বিষয়ে জেলা উপ-পরিচালক বলেন, আমরা বীজ দিচ্ছি। সামনে সার দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করা হবে। আর আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকার যেসব প্রণোদনা দিচ্ছে সেগুলো গ্রহণের পারমর্শ দেন তিনি।
শুধু ধানের জমিতে নয় বরং চরাঞ্চলেও সরিষার ব্যাপক চাষাবাদ হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকা, হাওড় ও পার্বত্য এলাকায় সরিষার চাষ বাড়ছে। প্রতি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধির আলাদা পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক কৃষক গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বীজ-সার দিয়ে সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ফলমূল ও সবজির মতো তেলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার তিন বছরের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল জাত ও জমির পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে মোট উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
ফলে কৃষকরা সহায়তা পেয়ে উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হচ্ছে। এটা কৃষকদের জন্য একটি বাড়তি ফসল। তারা আমন চাষের পর বোরো করার আগে জমি পতিত থাকত। এখন সেখানে বাড়তি সুবিধা পাওয়া কৃষকরা খুশি। সারাদেশেই এভাবে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। আমরা তাদের স্বল্প জীবনকালের ফসলের বীজ দিচ্ছি। ফলে বিঘা প্রতি তাদের ৩০-৩৫ হাজার টাকার মতো লাভ হবে।
উল্লেখ্য, গ্রামের এসব প্রদর্শনী কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রথমে সাড়া কম পাওয়া গেলেও এখন অনেকেই সরিষা চাষ করতে চাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। বিনামূল্যে বীজ পেতে কৃষকরা এখন কৃষি অফিসে আসছেন। এভাবে তিন বছরে ১৭ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন বাড়ানো হবে। আর সরিষার উৎপাদন বাড়বে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। আড়াই লাখ মেট্রিক টন চিনাবাদামের উৎপাদন বাড়ানো হবে। আর এতে করে কমে আসবে ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা।