খাদ্যে ভেজাল? পণ্যের মান নিয়ে সমস্যা? দাম বেশি রাখছে পণ্যের? অনলাইনে পণ্য ক্রয় করে প্রতারিত হয়েছেন? পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে বিক্রেতা তথ্য দিচ্ছে না? উল্লেখিত এসব প্রশ্নের যেকোনো একটির উত্তরও যদি হ্যা হয়ে থাকে তাহলে আপনি সহজেই ভোক্তা অধিকার সেবা গ্রহণের মাধ্যমে এরকম বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতে পারেন। উল্লেখিত এসব সমস্যা ছাড়া সমাজে চলতে ফিরতে এরকম নানা সমস্যায় প্রতিনিয়ত ভুক্তভোগী ক্রেতা সাধারণ। পণ্য ক্রয় সহ উল্লেখিত এসব প্রতারণার হাত থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনের ফলে কোনো ভোক্তা পণ্য ক্রয়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, মূল্যসহ কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলে তার প্রতিকার পেয়ে থাকেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি সম্পর্কে অবগত নয়। এমনকি শিক্ষিত সমাজের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যেও এই আইন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। এই আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার দরুন প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। নিজেদের নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় চলুন জেনে নেওয়া যাক ভোক্তা অধিকার আইন ও এর ব্যবহার সম্পর্কে।
কি আছে ভোক্তা অধিকার আইনে?
২০০৯ সালে প্রণীত ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এছাড়াও কয়েকটি
ধারার উপধারা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ধারার মধ্যে অন্যতম হলো,
ভোক্তা অধিকার আইনের ৩৭ ধারা মোতাবেক পণ্যের মোড়ক না থাকলে বা মোড়কে
পণ্যের তথ্য না থাকলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা
অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৩৮ ধারায় পণ্যের দাম সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে না রাখলে ১ বছরের কারাদণ্ড
বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
৩৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে, সেবার দাম সংরক্ষণ এবং সহজে দৃশ্যমান কোনো
স্থানে না রাখলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা
অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪০ ধারা অনুযায়ী, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, সেবা বা ওষুধ বিক্রি
করলে বিক্রেতা অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়
দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪১ ধারা অনুযায়ী ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের
কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ৪২
ধারা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো নিষিদ্ধ দ্রব্য
মিশিয়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা
অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪৩ ধারায় উল্লেখ আছে, জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমন পণ্য অবৈধ
উপায়ে বিক্রি করলে বিক্রেতা অনধিক ২ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা
অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
৪৪ ধারায় উল্লেখ আছে, পণ্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা
করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে
দণ্ডিত হতে পারেন ইত্যাদি।
যেসব ক্ষেত্রে
(ক) কোন আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(খ) জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(গ) মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন
খাদ্যপণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে,
উক্তরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোন পণ্য বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(ঘ) কোন পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা;
(ঙ) প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা;
(চ) কোন পণ্য সরবরাহ বা বিক্রয়ের সময়ে ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
(ছ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ওজন
পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা
অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া;
(জ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা;
(ঝ) কোন পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য
পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা
অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া;
(ঞ) কোন নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা;
(ট) মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় করা বা করিতে প্রস্তাব করা;
(ঠ) সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হইতে পারে এমন কোন কার্য করা, যাহা কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে;
যেভাবে ভোক্তা অধিকার আইনে সেবা নিবেন
অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি খুবই সহজ। বর্তমানে প্রত্যেকের হাতে হাতে
স্মার্টফোন। গুগোল প্লে-স্টোরে সংরক্ষিত ‘ভোক্তা অধিকার ও অভিযোগ’ অ্যাপসের
মাধ্যমে খুব সহজেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে অভিযোগ দায়ের করা যায়।
এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে সরাসরি ইমেইলের (nccc-dncrp.gov.bd)
মাধ্যমেও অভিযোগ করা যায়। ই-মেইলে অভিযোগকারীর নাম, পিতা-মাতার নাম,
ঠিকানা, ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ঘটনার বিবরণ
এবং প্রমাণস্বরূপ পণ্য ক্রয়ের রসিদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে।
এছাড়া ০১৭৭৭৭৫৩৬৬৮ ও ০৩১-৭৪১২১২ নম্বরে কল দিয়েও অভিযোগ জানানো যাবে। এরপর
তদন্ত শেষে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে যে আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫
শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেয়া হবে। তবে অভিযোগটি পণ্য
কেনার ৩০ দিনের মধ্যে দায়ের করতে হবে।
ভোক্তা হিসেবে যারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাবে প্রতারিত হচ্ছেন তারা সহজেই বিনা মূল্যে ভোক্তা অধিকারের আইনী সুবিধা নিয়ে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারেন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে এবং এর আইনি ব্যবহার করে সেবা গ্রহণ করলে অতি দ্রুত সমাজ থেকে উল্লেখিত এসব প্রতারণা বন্ধ হয়ে যাবে।