দেশে আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প সম্পন্ন হতে চলেছে। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে এ লক্ষ্যে গৃহীত ও পরিকল্পিত সকল প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ই-নামজারি সিস্টেম, নাগরিকদের অনলাইনে দাখিলা প্রদান ও ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান, মৌজা ম্যাপ তথ্য অনলাইনে প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া সমগ্র বাংলাদেশের ১,৩৮,০০০টি ম্যাপকে ডিজিটাইজ করাসহ স্যাটেলাইট ইমেজ ক্রয় করা হচ্ছে। এই ম্যাপের ওপর স্যাটেলাইট ইমেজ বসিয়ে প্লটভিত্তিক জমির শ্রেণির একটি তথ্যভা-ারও তৈরি হচ্ছে।
২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। গত মার্চে ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। নামজারির সঙ্গে-সঙ্গে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হতে থাকবে। একই খতিয়ানের মধ্যে বহুমুখী দাগ শেয়ার করা তথা হাতের লেখা খতিয়ান প্রথার অ্যানালগ পদ্ধতির উত্তরণ ঘটিয়ে ড্রোন দিয়ে ডিজিটাল জরিপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এ সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হলে দেশে ভূমি সংক্রান্ত মামলা সিংহভাগ কমে যাবে বলে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন। তিনি বলেন, প্লট টু প্লট জরিপ সম্পন্ন হলে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানার তথ্যটি সহজেই জানা যাবে। এর মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনার আমূল পরিবর্তন হবে। আদালতে মামলা হ্রাস পাবে, রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। জমির মালিকানার তথ্য পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে জানা যাবে এবং জনগণ প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বৃহৎ ভূস্থানিক উপাত্ত প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
নির্ধারিত সময়ে আধুনিক ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করতে রাজধানীতে ভূমি সম্মেলন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এই সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য টেকসই ও স্মার্ট ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। আমরা চাচ্ছি ২০২৬ সালের মধ্যে বর্তমানে গৃহীত ও পরিকল্পিত সব প্রকল্পের পূর্ণ বাস্তবায়ন। ২০২৬ সালে আমরা এমন একটি ব্যবস্থা দেখতে চাই যেখানে খতিয়ানের দাগ শেয়ার হবেনা এবং মালিকভিত্তিক খতিয়ান হবে।
এটা হলে ভূমি নিয়ে মামলা-মোকাদ্দমা ও সীমানা বিরোধ কমে যাবে। এনআইডি দিয়েই যেন পাওয়া যায় জমির সকল তথ্য- এই ব্যবস্থা করাও আমাদের পরিকল্পনায় আছে। সর্বোপরি দ্রুত সারাদেশে বাংলাদেশ ডিজিটাল জরিপ (বিডিএস) বাস্তবায়ন করা। যেসব জায়গায় একবার এই ডিজিটাল জরিপ সম্পন্ন হবে, সেখানে ভবিষ্যতে আর জরিপ করার প্রয়োজন পড়বে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ই-নামজারি ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রতি মাসে অনলাইনে প্রায় ২ লক্ষাধিক নামজারি নিষ্পত্তি হচ্ছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে প্রায় ৮৪ লাখ নামজারি মামলা। এ পর্যন্ত নামজারি সিস্টেম থেকে অনলাইনে আদায়কৃত প্রায় ১৬০ কোটি টাকা তাৎক্ষণিকভাবে সরকারের কোষাগারে জমা হয়েছে। ২০২১ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটির অধিক হোল্ডিং ডাটা ম্যানুয়াল থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে। নাগরিককে অনলাইনে দাখিলা প্রদান করা হয়েছে প্রায় ৫৭ লক্ষের অধিক।
অনলাইনে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হয়েছে ৫১৯ কোটি টাকা যা তাৎক্ষণিকভাবে অটোমেটেড চালান সিস্টেমের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে। বর্তমানে ৫ কোটি ২১ লাখের অধিক জমির মালিকানা এবং ৭৫ হাজারের অধিক মৌজা ম্যাপ তথ্য অনলাইনে রয়েছে। ডাক বিভাগ এখন নাগরিকের ঠিকানায় খতিয়ান পৌঁছে দিচ্ছে। এ পর্যন্ত তিন লাখের অধিক খতিয়ান ডাক বিভাগের মাধ্যমে নাগরিকগণ হাতে পেয়েছেন। এ সিস্টেম থেকে প্রায় ১৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা সরকারি রাজস্ব আদায় হয়েছে। প্রতিনিয়ত নামজারি খতিয়ান যুক্ত হচ্ছে এ সিস্টেমে।
১৬১২২ নম্বরে ফোন করে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো সময় (২৪/৭) যে কোনো নাগরিক এখন ভূমি অফিসে না এসেই নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর এবং খতিয়ান সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। কল সেন্টার থেকে প্রায় ১০.২০ লাখ কল নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে নিষ্পত্তিকৃত কলের সংখ্যা প্রায় ৬০০০। প্রায় ১১,৪০০ ফলো-আপ কল (কল ব্যাক) করা হয়েছে। নাগরিকগণকে ২০,৮০০টি ভূমি সংক্রান্ত আইনি পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
সমগ্র বাংলাদেশের ১,৩৮,০০০টি ম্যাপকে ডিজিটাইজ করা হচ্ছে। ২০২৩ সালের মার্চ নাগাদ ২০ হাজার ডিজিটাল মৌজা ম্যাপ ই-নামজারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। নামজারির সঙ্গে-সঙ্গে এই ডিজিটাল ম্যাপ ও খতিয়ান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হতে থাকবে। একই খতিয়ানের মধ্যে মাল্টিপল দাগ শেয়ার করা তথা হাতের লেখা খতিয়ান প্রথার অ্যানালগ পদ্ধতির উত্তরণ ঘটিয়ে ড্রোন দিয়ে ডিজিটাল জরিপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
অনলাইন ব্যবস্থার কারণে ১৬৯৯টি জলমহাল কম ইজারা দিয়েও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১ কোটি টাকা! ২০২২ এর জুন মাস পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট কৃষি খাস জমি ১৭,৩৫,৯১৫ একর, এরমধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য ৪,৬০,১৬৪ একর। মোট অকৃষি খাস জমি ২২,৫০,১৭০ একর, যার মধ্যে বন্দোবস্তযোগ্য ১,১৫,৭৬৩ একর।
সূত্র জানায়, অধিগৃহীত জমির সর্বোচ্চ এবং যথাযথ ব্যবহার করা হলে এবং দুই ফসলি ও তিন ফসলি জমি অধিগ্রহণের আওতাবহির্ভূত রাখা হলে কৃষি জমি সংক্ষণের ব্যবস্থাসহ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা সম্ভব হবে। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ‘ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩’ প্রণয়নের জন্য আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনটি প্রণীত হলে কৃষি জমি সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ ভূমি ব্যবস্থার সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হবে।
দেশের বা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে মামলার যে কোনো পক্ষ ভূমি রাজস্ব মামলায় যাতে অনলাইন শুনানিতে অংশ নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ভূমি রাজস্ব বিষয়ে সেবা প্রত্যাশী জনগণ উপকৃত হচ্ছেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো সিভিল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন দেওয়ানি মামলা ও ভূমি রাজস্ব মামলাগুলো দ্রুত, স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। বেশ কিছু পুরনো আইন সংস্কার করে যুগোপযোগী করা এবং কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যে হলো, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২৩ এবং ভূমির মালিকানা ও ব্যবহার আইন, ২০২৩।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় তিনটি জরিপ বিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর মধ্যে মৌজা ও প্লটভিত্তিক ডিজিটাল ভূমি জোনিং প্রকল্প সরাসরি ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি দক্ষ ব্যবহার। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের আওতায় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ধামরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা এবং মানিকগঞ্জ পৌরসভায় ডিজিটাল ল্যান্ড সার্ভে করা হবে।
এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে ম্যাপ ও রেকর্ডের ইন্টিগ্রেশন হবে। এ প্রকল্পে ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যার প্রস্তুত করা হবে। সকল ডাটা ক্লাউড বেজ সার্ভারে সংরক্ষণ করা হবে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলা এবং গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া ও কোটালিপাড়াসহ ৩২টি উপজেলায় ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।