নিজস্ব প্রতিবেদক:
সারা দেশেই জেলা ও উপজেলা প্রশাসন ও বিচারিক কর্মকর্তারা নানা সভা সমাবেশে ভাস্কর্যবিরোধীদেরকে সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী জাতির পিতার সম্মান রক্ষা করা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব। আর সেটা তারা পালন করবেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে দেশের ৬৪ জেলার পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনেও হয়েছে প্রতিবাদ। এসব আয়োজন থেকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবমাননা করলে তার পরিণতি ভালো হবে না।
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেদের এই ধরনের কোনো আয়োজন সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।
শনিবার এসব আয়োজনে কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধারাও শামিল হন।
এসব কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে অবিচ্ছেদ্য উল্লেখ করে তার ভাস্কর্য ভাঙচুরে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
সভায় তুলে ধরা হয়েছে একটি বার্তা, ‘জাতির পিতার সম্মান, রাখব মোরা অম্লান।’
রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে কুষ্টিয়ায় একটি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ক্ষুব্ধ করে তুলেছে গোটা দেশকে। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
এসব প্রতিবাদে এবার সামিল হলেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
শপথ পড়ালেন ডিসি
শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধুর সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার বিষয়ে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের শপথ পড়িয়েছেন শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এই সভায় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মান সমুন্নত আছে, থাকবে। কেউ কোনোদিন পারেনি, পারবেও না তাকে অসম্মান করতে।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন এসপি এসএম আশরাফুজ্জামান, সিভিল সার্জন আব্দুল্লাহ আল মুরাদ।
‘সরকারি চাকুরেরা নামলে অস্তিত্ব থাকবে না’
চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমাবেশে বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাস্তায় নামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বিরোধিতাকারীদের অস্তিত্ব থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘যদি আপনারা আর কখনও এই ধরনের দুঃসাহস দেখান আর কোনো প্রকার সুযোগ যদি আপনারা নেন, তাহলে আপনাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেব। আমরা সরকারি চাকুরিজীবীরা জানি, কীভাবে সে কাজটি করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর যে আঘাত, এ আঘাত শুধু আঘাত হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এটি গভীর ষড়যন্ত্রের একটি নমুনা।’
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সচেতন থাকতে হবে, চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমরা শুধু একটি মেসেজ দেয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছি। এই যে পরাজিত শত্রু, স্বাধীনতাবিরোধী শত্রু, বাংলাদেশের অস্তিত্ব যারা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে, তাদের সে দুঃসাহস না করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেনের সভাপতিত্বে সমাবেশে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর, চট্টগ্রাম বন্দর পর্ষদের সদস্য জাফর আলম, বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাসান শাহরিয়ার কবির, জেলা দায়রা জজ মো. ইমাইল হোসেন, চা বোর্ড কর্মকর্তা নাজনিন কবির, এলজিইডি কর্মকর্তা আশিস কুমার বড়ুয়া প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব জাতির জনকের সম্মান রাখা’
ফরিদপুরে জসীম উদ্দীন মিলনায়তনে সমাবেশে জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, বঙ্গবন্ধুর যেকোনো ধরনের অবমাননা বা সম্মানহানি বাংলাদেশের সম্মানহানিরই নামান্তর, যা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারীর দায়িত্ব হচ্ছে সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আর সেই সংবিধানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার মর্যাদা সমুন্নত রাখার বিধান করা হয়েছে।
জেলা ও দায়রা জজ সেলিম মিয়া, পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান বিপিএম, সিভিল সার্জন ছিদ্দিকুর রহমান, বিসিএস শিক্ষা সমিতির সভাপতি প্রফেসর মোশাররফ আলী, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুম রেজা প্রমুখ এ সময় বক্তব্য রাখেন।
পরে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা আনসার কমান্ডার ও ফায়ার ব্রিগেডের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পুলিশ, আনসার ও ফায়ার ব্রিগেডের সুসজ্জিত সদস্যদের এক প্রতিরোধ পদযাত্রা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
‘মৌলবাদীদের রুখে দেব’
যশোর শহরের দড়াটানায় মানববন্ধনে সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন বলেন, ‘মৌলবাদীদের এ ধরনের আচরণ সহ্য করা হবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এদের রুখতে হবে।’
জেলা পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনসহ এ সময় বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
‘বঙ্গবন্ধু ওপর হামলা মানে জাতিসত্তায় আঘাত’
চাঁদপুর শহরের শিল্পকলা একাডেমিতে প্রতিবাদ সভায় জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর হামলা মানে বাঙালি জাতিসত্তার ওপর হামলা। জাতির পিতার কোনো প্রকার অসম্মান সহ্য করব না।’
পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধুর অসম্মান করে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
‘ভাস্কর্য নিয়ে অপরাজনীতি’
সুনামগঞ্জে প্রতিবাদ সভায় জেলা ও দায়রা জজ ওয়াহিদুজজামান শিকদার বলেন, ‘আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে কথা হচ্ছে, অপরাজনীতি করা হচ্ছে। আপনারা সর্তক থাকুন, আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি, আর কিছু যেন না হারাই।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের সভাপতিত্বে এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এসপি মিজানুর রহমান ও সিভিল সার্জন শামস উদ্দিন।
মুখ্য বিচারিক হাকিম আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনার, আমার অধিকার আদায়ের জন্য জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছে জেলাখানার চার দেয়ালে। তাহলে সম্মান দেখাতে কেন কার্পণ্য?’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদের সভাপতিত্বে এ সময় বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান প্রমুখ।
‘বঙ্গবন্ধুর সম্মানহানি মেনে নেয়া যায় না’
মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন ডিসি এম মুনছুর আলী খাঁন।
জেলা দায়রা জজ এস এম আবদুস সালাম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। অথচ দেশের একটি কুচক্রীমহল বঙ্গবন্ধুর সম্মানহানি করতে চায়। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা ও দায়রা জজ এসএম আব্দুস সালাম, পুলিশ সুপার এসএম মুরাদ আলীসহ বিভিন্ন দফতরের সরকারি কর্মকর্তারা।
‘এটা লজ্জার’
রাজবাড়ী জেলা অফিসার্স ক্লাব চত্বরে শনিবার সকালে প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মান রক্ষার্থে সমাবেশ করতে হচ্ছে, এটা সব থেকে লজ্জার বিষয়।’
‘এটা বাংলাদেশের অবমাননা’
মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন বলেন, ‘সংবিধান বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা মানে স্বাধীন বাংলাদেশকে অবমাননা করা।’
জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌসের সভাপতিত্বে সভায় পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীম, সিভিল সার্জন আনোয়ারুল আমিন আখন্দসহ জেলার পাঁচ শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
‘হৃদয়ের বঙ্গবন্ধুকে কে ভাঙবে?’
নাটোরের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মিলনায়তনে সভায় জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেন, ‘ভাস্কর্য ভেঙে বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলা যাবে না। কোটি মানুষের হৃদয়ে যে বঙ্গবন্ধু আছে, সেটা ভাঙবে কী করে?’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা, সিভিল সার্জন কাজী মিজানুর রহমান।
‘এই আঘাত জাতির স্বকীয়তায়’
বরিশালে প্রতিবাদ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে তিনটি সংগঠন। দুপুরে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশ করে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সহকারীদের সংগঠন অশ্বিনী কুমার হলের সামনে মানববন্ধন এবং নগরীর নাজিরমহল্লার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করে দি চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নেতারা।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা মানে আমাদের স্বকীয়তায় আঘাত হানা।’
‘মৌলবাদীরা দেশকে পিছিয়ে দিতে চায়’
নোয়াখালী সদর উপজেলা পরিষদের সামনের আবদুল মালেক উকিল প্রধান সড়কে মানববন্ধন করে উপজেলা প্রশাসন। পরে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে হয় সমাবেশ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘একটি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দেশকে পিছিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করছে। বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা, ভাস্কর্যে হামলা ও ভাঙচুর সেই ষড়যন্ত্রের পূর্বপরিকল্পিত নীলনকশা। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সাবধান করতে সরকারি চাকুরিজীবীদের প্রত্যেক নিজ নিজ অবস্থান থেকে কথা বলতে হবে।’
‘আর অবমাননা করতে দেয়া হবে না’
নেত্রকোনা পৌরভবনের সামনে সমাবেশে জেলা প্রশাসক কাজি আব্দুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এক সুতায় গাঁথা। যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর সম্মান বজায় রাখবে। কোনো অপশক্তিকেই বঙ্গবন্ধুর কোন অবমাননা করতে দেয়া হবে না এই বাংলায়।’