সাহিত্যশুরু হলো ভাষা শহিদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষা প্রসঙ্গে বৈদিক সাহিত্যে কি আছে তা’ জানার আগ্রহ থেকে আমার এই ছোট্ট প্রয়াস।
পাঁচ হাজার বছর প্রাচীন ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলে একাত্তরতম সূক্তের কয়েকটি ঋকে ভাষা, বাক্য, অর্থ, জ্ঞান প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। সেযুগে ভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ কি ভাবে শুরু হতো তারও ইঙ্গিত রয়েছে এই সূক্তে। বলা যায়, সে যুগের শিক্ষা সম্পর্কিত ভাবনার কিঞ্চিৎ আভাস। সূক্তের ঋষি বৃহস্পতি এবং ছন্দ গায়ত্রী ও জগতী।
বৃহস্পতে প্রথমং বাচো অগ্রং যৎ প্রৈরত নামধেয়ং দধানাঃ।
যদেষাং শ্রেষ্ঠং যদরিপ্রমাসীৎপ্রেণা তদেষাং নিহিতং গুহাবিঃ।। ১
(হে বৃহস্পতি! বালকেরা সর্বপ্রথম বস্তুর নাম মাত্র করতে পারে, সেটাই তাদের ভাষা শিক্ষার প্রথম সোপান। যা কিছু উৎকৃষ্ট ও নির্দোষ জ্ঞান তাদের হৃদয়ের নিগূঢ় স্থানে সঞ্চিত ছিল, তা বাগদেবীর করুণাক্রমে বিকশিত হয়।)
শক্তুমিব তিতউনা পুনন্তো যত্র ধীরা মনসা বাচমক্রত।
অত্রা সখায়ঃ সখ্যানি জানতে ভদ্রৈষাং লক্ষ্মীর্নিহিতাধি বাচি।। ২
(যেমন চালুন দিয়ে ছাতুকে পরিষ্কার করা হয় সেরূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তি মেধাবলে পরিচ্ছন্ন ভাষা সৃষ্টি করেন। সে ভাষাতে সুহৃদগণ উপকৃত হন। তাঁদের রচনাশৈলীতে ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ ভাষাদৃষ্ট হয়।)
যজ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ং তাম্ অন্ববিন্দন্ ঋষিষু প্রবিষ্টাম্।
তাং আভৃত্যা বাদধুঃ পুরুত্রা তাং সপ্ত রেভাঃ অভি সং নবস্তে।। ৩
(বুদ্ধিমানগণ দীর্ঘ সাধনা দ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হন। ঋষিদের (শিক্ষকদের) অন্তঃকরণ মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিল তা তাঁরা প্রাপ্ত হন। সে ভাষা আহরণ করে তাঁরা নানা স্থানে বিস্তার করেন। সপ্তছন্দ সে ভাষাতেই রচিত হয়।)
উত ত্বঃ পশ্যৎ ন দদর্শ বাচম্ উত ত্বঃ শৃণ্বৎ ন শৃণোতোনাম্।
উতো ত্বস্মৈ তন্বংবি সস্রে জায়েব পত্য উশতি সুবাসাঃ।। ৪
(কেউ পড়েও বক্তব্যের ভাবার্থ গ্রহণ করতে পারে না, কেউ শুনেও শ্রোতব্য উপলব্ধি করতে পারে না। পত্নীর সব সৌন্দর্য প্রকাশের আধার যেমন পতি, তেমনি বাগদেবীর সকল কলাজ্ঞান কোন কোন ব্যক্তির নিকট প্রকাশিত হয়।)
উত ত্বং সখ্যে স্থিরপীতমাহুর্নৈনং হিন্বন্ত্যপি বাজিনেষু।
অধেন্বা চরতি মায়য়ৈষ বাচং শুশ্রুবাঁঅফলাম্ অপুষ্পাম্।। ৫
(সমাজে কোন কোন ব্যক্তির এমন পাণ্ডিত্যাভিমান হয় যেন তিনিই সর্বোত্তম ভাবগ্রাহী, তাঁকে ছাড়া কোন কাজ হবে না। কেউ ফলপুষ্পহীন অসার বাক্য অভ্যাস করে। সে বাক্য দুগ্ধপ্রদ গাভী নয়, কাল্পনিক মায়াগাভী মাত্র।)
যস্তিত্যাজ সচিবিদং সখায়ং ন তস্য বাচ্যপি ভাগো অস্তি।
যদীং শৃণোত্যলকং শৃণোতি নহি প্রবেদ সুকৃতস্য পন্থাম্।। ৬
(বিদ্বান বন্ধুকে যে ত্যাগ করে তার কথায় কোন ফল নাই। সে যা কিছু শুনে বৃথাই শুনে, সে সৎকর্মের পন্থা অবগত হতে পারে না।)
অক্ষন্বন্তঃ কর্ণবন্ত সখায়ো মনোজবেষ্বসমা বভূবুঃ।
আদঘ্নাস উপকক্ষাস উ ত্বে হ্রদা ইব স্নাত্বা উ ত্বে দদৃশ্রে।। ৭
(যাদের দেখার মতো চোখ এবং শোনার মতো কান আছে এমন বন্ধুগণ মনের ভাব প্রকটন বিষয়ে অসাধারণ। যে হ্রদের জলে কেবল কৌপীন পর্যন্ত ডোবে সে যেমন অগভীর, কোন কোন বিদ্বান ব্যক্তির জ্ঞান তেমনই অগভীর। আবার কেউ কেউ বা অবগাহনের উপযুক্ত হ্রদের ন্যায় সুগভীর জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে থাকেন।)
হ্রদা তষ্টেষু মনসো যবেষু যদ্ব্রাহ্মণাঃ সংযজন্তে সখায়ঃ।
অত্রাহ ত্বং বি জহুর্বেদ্যাভিরোহ ব্রহ্মাণো বি চরন্তু ত্বে।। ৮
(যখন অনেক স্তোতা একত্র হয়ে মনের ভাব সমস্ত হৃদয়ে আলোচনা পূর্বক অবধারিত করতে প্রবৃত্ত হন, তখন কোন কোন ব্যক্তির কিছুই জ্ঞান জন্মে না। কেউ কেউ স্তোত্রবিশারদ বলে পরিচিত হয়ে সর্বত্র বিচরণ করেন।)
বৈদিক সাহিত্য চর্চার সহায়ক চারটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে মুণ্ডক উপনিষদে। এগুলি ভাষাকে সুসংহত পরিশীলিত করার উদ্দেশ্যে প্রণীত। এরা হলো শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ ও নিরুক্ত।
‘শিক্ষা’র আলোচ্য বিষয় ধ্বনিতত্ত্ব, অর্থাৎ শব্দের উচ্চারণ এবং অক্ষরের বা শব্দের উপর প্রদত্ত ঝোঁক(accent) নিয়ে। কোন প্রসঙ্গের প্রেক্ষিতে অক্ষর বা এক কালে উচ্চার্য শব্দাংশ(syllable) কি ভাবে উচ্চারণ করতে হবে।
‘ছন্দ’ প্রকরণ মাত্রাবিজ্ঞান। ছন্দ ভাষাকে শ্রুতিমধুর করে। শুধুমাত্র কাব্য নয়, গদ্যের ভাষা মসৃণ হলে গদ্য চিত্তাকর্ষক হয়, গদ্যকেও ছন্দময় প্রবাহমান অনুভূত হয়।
ভাষার শুদ্ধতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন থেকে ব্যাকরণের উদ্ভব। ব্যাকরণ না জানলে পদের অর্থগ্রহণ সহজ হয় না।‘নিরুক্ত’ শব্দবিজ্ঞান। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে ব্যবহার ভেদে শব্দের অর্থ নির্দেশ করা নিরুক্তর লক্ষ্য।
লেখক: অধ্যাপক শেখর কুমার স্যানাল