ভারতে শিক্ষাগত বৃত্তিপ্রদান কার্যক্রম
ভারত বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বিশ্বমানের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে সেরা মেধাবীগণ অনবদ্য শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে তাঁদের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পান। এই তরুণ প্রতিভাবানগণ তাদের সফল শিক্ষাগত সাধনা শেষে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্পকলা ও অন্যান্য আধুনিক খাতের মতো নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। ভারতীয় সরকার মেধাবী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন বৃত্তিপ্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সেগুলো হলো:
১. আইসিসিআর বৃত্তি কার্যক্রমসমূহ: স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত (এপ্রিল ৯,১৯৫০) ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (আইসিসিআর) প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি কোর্সের জন্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি প্রদান করে থাকে। এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশের ৪৫০০জনেরও বেশি শিক্ষার্থী এই পূর্ণবৃত্তি কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন, যেখানে ভারত সরকার তাঁদের একটি পর্যাপ্ত অংকের উপবৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি টিউশন ফি, বাসস্থান, শিক্ষাসফর ও পরিবহনের জন্য সম্পূর্ণ অর্থ প্রদান করে। কয়েকজন বিখ্যাত বাংলাদেশি আইসিসিআর অ্যালামনাইয়ের মাঝে অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন বুয়েটের ভাইস-চ্যান্সেলর সত্য প্রসাদ মজুমদার, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য, নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সুবর্ণ জয়ন্তী বৃত্তি (এসজেএস) প্রকল্পের অধীনে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০০টি স্লট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বছরে, ১৪৭জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভারতের আইভি লিগ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (যেমন আইআইটি/এনআইটি/ডিটিইউ/জিটিইউ) অধ্যয়ন করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, আরও ৩৫১জন প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নন-ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়সমূহে (যেমন: দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, পুনে বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়) পড়তে গিয়েছেন।
খ. লতা মঙ্গেশকর বৃত্তি প্রকল্পের অধীনে, ভারতীয় সংস্কৃতির জন্য, ৫৫ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এই বছর সারা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানসমূহে স্থান অর্জন করেছেন।
গ. আয়ুষ (আয়ুর্বেদ যোগ ইউনানী সিদ্ধ হোমিওপ্যাথি) বৃত্তি প্রকল্পের অধীনে, ৪৭ জন বাংলাদেশি বিকল্প চিকিৎসা বিষয়ে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেছেন।
২. এমইএ–এফআরআই বৃত্তি প্রকল্প: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ফরেস্ট্রি ও সহযোগী প্রোগ্রামসমূহে এমএসসি করার জন্য প্রতিবছর দশটি পূর্ণবৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত।
৩. স্টাডি ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচি: এটিইডিসিআইএল-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত, ভারত সরকারের একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প, যার কর্মসূচি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থীরা এসে ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেরা একাডেমিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। ডিপ্লোমা, আন্ডারগ্র্যাজুয়েট, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট, মাস্টার্স ও পিএইচডি-র বিভিন্ন স্তরে ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজনেস, ম্যানেজমেন্ট, ফটোনিক্স, ফার্মেসি, আইন, বাণিজ্য, মানবিক ও অন্যান্য বিশেষ কোর্সসহ বিভিন্ন কোর্সে অধ্যয়ন করার জন্য শিক্ষার্থীরা এই প্রোগ্রামের অধীনে সম্পূর্ণ টিউশন ফি মওকুফের জন্য প্রতিযোগিতা করে থাকেন। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ১৫০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
৪. সেল্ফ ফাইন্যান্সিং স্কিম (এসএফএস) কর্মসূচি: এই প্রকল্পটি এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্স (এনইইটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আবেদনকারীগণের ক্ষেত্রে), বি.ই./বি.টেক., বি.ফার্মেসি ও বি.আর্ক কোর্স অফার করে থাকে, যেখানে প্রার্থী স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব অর্থায়নে অধ্যয়ন করেন।
(খ) ভারতে প্রফেশনাল বৃত্তিসমূহ
ভারত এখন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছেছে এবং আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে জ্ঞান বিনিময় করছে, যাদেরকে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এরপরে এই প্রশিক্ষিত প্রফেশনালগণ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র যেমন, আইটি, জ্বালানি, ইঞ্জিনিয়ারিং, রোবোটিক্স, অ্যাডভান্সড কম্পিউটিং, ন্যানোপ্রযুক্তি, রিনিউয়েবল এনার্জি, সাইবার নিরাপত্তা, অডিট/অ্যাকাউন্টস, ব্যাংকিং, জনপ্রশাসন ও শিক্ষকতায় শীর্ষস্থানীয়দের মাঝে সফল অবস্থান অধিকার করেন।
ভারতীয় প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা (আইটেক) কর্মসূচি ১৯৬৪ সাল থেকে আজ অবধি সর্বাধিক প্রভাববিস্তারকারী সক্ষমতাবৃদ্ধিকরণ কর্মসূচিগুলোর মাঝে একটি। প্রতিবছর, ভারতজুড়ে ৬০টিরও বেশি তালিকাভুক্ত অভিজাত প্রতিষ্ঠান আইটেক কর্মসূচির অধীনে ৩০০টিরও বেশি স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কোর্স পরিচালনা করে থাকে। কোর্সগুলো সম্পূর্ণরূপে ভারত সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত হয়, যেখানে প্রশিক্ষণার্থীদের বিনামূল্যে পরিবহণ, বাসস্থান, শিক্ষাসফর ও গ্রন্থভাতা প্রদান করা হয়ে থাকে। আইটেক বাংলাদেশসহ অংশীদার দেশগুলোর জন্য সক্ষমতাবৃদ্ধিকরণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান উন্নয়ন সহযোগিতামূলক উদ্যোগে পরিণত হয়েছে।
আইটেক গত ৫৮ বছরে সামগ্রিকভাবে ২,০০,০০০ প্রফেশনালকে উপকৃত করেছে। আজ, আমরা প্রায় ১০০টি অগ্রগণ্য ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে ১৬০টি অংশীদার দেশ থেকে প্রফেশনালদের উদ্দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৪,০০০ বৃত্তি প্রদান করে থাকি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ৪,৫০০ জনেরও বেশি তরুণ বাংলাদেশি প্রফেশনাল ২০০৭ সাল থেকে আইটেক কর্মসূচির অধীনে ভারতে এই জাতীয় বিশেষায়িত স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী কোর্স করেছেন। আমরা এই প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোকে প্রাসঙ্গিক, সমসাময়িক ও চাহিদাভিত্তিক রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের সুযোগ, সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন (ফিজিবিলিটিস্টাডিজ) ও পরামর্শ পরিষেবা প্রদানকারী হিসেবে ভারতের সক্ষমতা সম্পর্কে অন্যান্য দেশের মধ্যে বর্তমানে একটি দৃশ্যমান ও ক্রমবর্ধমান সচেতনতা রয়েছে।
আইটেক ২.০ উন্মোচনের মাধ্যমে আইটেক-এ একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই নতুন উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে আইটেক-এক্সিকিউটিভ (আমাদের আইআইটি ও আইআইএম-এর মতো শীর্ষস্থানীয় পাবলিক প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রফেশনাল, নীতিনির্ধারক ও টেকনোক্র্যাটদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে), আইটেক-অনসাইট (ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা সাইটে গিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করার জন্য অংশীদার দেশগুলোতে যান) ও ই-আইটেক কর্মসূচি (লাইভ অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য)। ভারতের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান যেমন: আইআইটি-কানপুর, সিডিএসি-পুনে, আইআইএসসি-বেঙ্গালুরু, ফরেনসিক সায়েন্স ইউনিভার্সিটি-গুজরাট, এনআইডব্লিউই-চেন্নাই, ন্যাশনাল সেন্টার ফর গুড গভর্নেন্স (এনসিজিজি), ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি (এনজেএ), ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট (আইআইআইডিইএম), পার্লামেন্টারি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসিস (পিআরটিআইডি), অরুণ জেটলি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেড (আইআইএফটি), ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনফরমেশন সিস্টেমস অ্যান্ড অডিট (আইসিআইএসএ) এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসমূহ পরিচালনা করে থাকে।
এইবছর, সুবর্ণ জয়ন্তী বৃত্তি (এসজেএস) কর্মসূচির সূচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে আইটেক-এর সম্পৃক্ততার একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী অংশগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত কর্মসূচি সমূহের বাইরেও আইটেক-এর জন্য ৫০০টি ডেডিকেটেড স্লট পেয়েছে।
যেহেতু বেসরকারি খাতের উদ্যোগসমূহ দেশে দ্রুত নিজেদের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, আমরা এটা ঘোষণা করতে পেরে আনন্দিত যে, সমস্ত আইটেক কোর্স এখন বেসরকারি খাতের প্রফেশনালদের নিজস্ব দক্ষতা উন্নয়নের জন্যও উন্মুক্ত।