সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে সাতটি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়েছে৷ দু’দেশের মধ্যকার স্বাক্ষরিত স্মারক ও চুক্তির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের ফেনী নদীর পানি বণ্টন নিয়ে। ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতকে দিতে সম্মত হয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয় নিয়ে বিভিন্নভাবে জল ঘোলা করার চেষ্টায় আলোচনা-সমালোচনা উঠলেও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ সম্পর্কিত চুক্তি বোঝার আগেই যারা সমালোচনায় মেতে উঠেছেন অথবা যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিতর্কিত করতে চান তারাই মূলত এ চুক্তির বিপক্ষে কথা বলছেন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ফেনীর পানি প্রত্যাহার চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে বিভিন্নভাবে। যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
* ত্রিপুরার সাবরুম শহরের মানুষের প্রতি বাংলাদেশের সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ: পানির অপর নাম জীবন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘আমি পানি থেকে সবকিছুকে জীবন দান করেছি।’ জীব-তরুলতার অস্তিত্ব ও বিকাশে সর্বযুগেই পানি প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানবধর্মে যে চারটি জিনিস সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে পানি অন্যতম।
এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি কোনো মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে পিপাসার্ত অবস্থায় পানি পান করায় তাহলে আল্লাহ তাকে রাহিকুল মাখতুম (জান্নাতের বিশেষ পানীয়) থেকে পান করাবেন।’ আহমদ, আবু দাউদ।
শতকরা ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশ, মূলত মানবিক বিবেচনায় পানি দিতে রাজি হয় ত্রিপুরাকে। ত্রিপুরার সাবরুমে বসবাসরত ৭১৪২ জন মানুষ পানির কষ্ট পাবে, সেটা চায়নি প্রধানমন্ত্রী। বিভিন্ন কারণের সঙ্গে উক্ত এলাকায় ১.৮২ কিউসেক পানি দেবার এটাও একটি বড় কারণ।
এছাড়া ত্রিপুরার সাবরুমের ভূগর্ভস্থ পানিতে আয়রন ও আর্সেনিকের মাত্রা বেশি। যার কারণে নিজের জীবন বাঁচাতে অবৈধভাবে ত্রিপুরার ফেনী নদীর বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি প্রত্যাহার করছে বলে জানা যায়। সেক্ষেত্রে একটি নিয়মের মধ্যে থেকে পানির নিয়ন্ত্রণ করাই যৌক্তিক। তাছাড়া কেউ খাওয়ার পানি চাইলে তা না করা যায় না। কাজেই পানি দেওয়াটাই মানবিক।
* একটি নদীর পানি দিয়ে ৫৩টি নদীর পানি পাওয়ার সম্ভাবনা: বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দিলে ভারত থেকে বাংলাদেশই বেশি সুবিধা পাবে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রথমত মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫৪টি নদ-নদীর মধ্যে একমাত্র ফেনী নদীর পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের কাছে। আর বাকি ৫৩টি পানি প্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ভারতের কাছে। ফলে এই এক নদীর পানি প্রদানের মধ্য দিয়ে যদি ৫৩টি নদীর পানি পাবার সুযোগ বাংলাদেশ পায়, সেটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলকর। সঙ্গে ফেনী নদীতে বার্ষিক পানির গড় পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৭৮ কিউসেক। সেই হিসাবে ভারত ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করলে তা হবে বাৎসরিক গড় পানি প্রবাহের ০.৯৬%। কাজেই নদীর পানির ওপর প্রভাব পড়বে না।
* ফেনী নদী পানির পরিবর্তে ত্রিপুরা চার নদী পানি পাবার সুযোগ: ভারত ছয়টি নদী- যথাক্রমে মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানিবণ্টন চুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। ওই ছয় নদীর চারটিই যথাক্রমে মনু, মুহুরি, খোয়াই ও গোমতী ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। সেক্ষেত্রে ফেনী নদীর পানি দিয়ে যদি আসন্ন ছয়টি নদী পানিবণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশ ত্রিপুরার সমর্থন পায়, তবে তা হবে বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার কারণে তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি আটকে আছে। সেক্ষেত্রে ত্রিপুরায় ফেনী নদীর পানি দেবার বিনিময়ে যদি উক্ত ছয় নদীর পানি পাওয়া যায় তা তিস্তা নদীর ঘাটতি সম্পূর্ণভাবে লাঘব করবে। ফলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মাধ্যমে ফেনী নদীর পানি দেবার মাধ্যমে বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই লাভবান হলো।
* আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিবাচক ইমেজ তৈরি: শুকনো মৌসুমে ফেনী নদীর সর্বনিম্ন পানির গড় পরিমাণ ৭৯৪ কিউসেক। সেই হিসাবে ভারত ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করলে তা হবে শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন গড় পানি প্রবাহের ০.২৩%। আর ০.২৩ ভাগ পানি দিলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতিই হবে না, উল্টো পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কূটনীতিক অঙ্গনে ইতিবাচক বার্তাও দেয়া গেলো।
* মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার প্রতিদান: মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরা বাংলাদেশকে সুবিধা দিয়েছিলো ব্যাপকভাবে। বর্তমান বাংলাদেশ ত্রিপুরাবাসীকে যে সাবরুমে পানি দিচ্ছে সেই সাবরুমেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী ও অনেক মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিলো। সে সময় ত্রিপুরার মানুষই আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পানিসহ বিভিন্নভাবে আশ্রয় দিয়েছিলো। কাজেই ফেনী নদীর পানি দিয়ে ত্রিপুরার মানুষের উপকারের মাধ্যমে তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হলো। সঙ্গে মানবিক বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না, ত্রিপুরাবাসী জীবনধারণের জন্য পানি পান করবেন, আর পানি যদি বাংলাদেশ তাদের দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে নিশ্চয়ই বিষয়টি অমানবিক হয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ কিংবা এ দেশের মানুষ অবিবেচক নয়।