নিজস্ব প্রতিবেদক:
সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি বা ব্লু-ইকোনমি অর্জনের ক্ষেত্রে গত ৮ বছরে বাংলাদেশ নিজেদের প্রস্তুতি পর্বটা সম্পন্ন করেছে বলে মনে করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি এবং তার তলদেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের জন্য প্রস্তুতিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সমুদ্রের অফুরন্ত ভান্ডার থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা অত্যন্ত টেকনিক্যাল কার্যপদ্ধতির বিষয়। সেখানে চাইলেই হুট করে বড় কিছু করে ফেলা সম্ভব নয়। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক শালিসি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় প্রায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায় বাংলাদেশ। এর পরই কখনো ধীরে কখনো দ্রুত গতিতে ব্লু ইকোনমি চূড়ান্ত অর্জনের জন্য কাজ করতে থাকে বাংলাদেশ। নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের পরের বছরই ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় এবং বিশ্বের ১২তম মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। ব্লু ইকোনমি অর্জনের লক্ষ্যে মেরিটাইম বিষয়ক উচ্চতর পড়াশোনার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘বিশেষায়িত’ বিশ্ববিদ্যালয় এটি। প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক দক্ষ পেশাজীবী বেরুচ্ছে, যারা ব্লু ইকোনমি অর্জনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবেন। অন্যদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনী সদর দফতরের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড) নামে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি ২০১৮ সালে সাবেক নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারের জন্য সামুদ্রিক বুদ্ধিজীবী, গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত করে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান সমুদ্র বিষয়ক সুরক্ষা, অনুসন্ধান, সমুদ্র সম্পদ সংরক্ষণ, সমুদ্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে মামলায় নতুন সমুদ্রসীমা অর্জনের দুই বছর পর ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ। এরপর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৭ সালে ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন করে সরকার। সমুদ্র সম্পদ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট করেছে সরকার।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র নানাভাবেই অবদান রেখে চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যে বলা হচ্ছে, বিশ্বের ৪৩০ কোটিরও বেশি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্রনির্ভর। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২৫ সালে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সে দেশের সরকার। এ ছাড়াও চীন, জাপান, ফিলিপাইনসহ বেশ কিছু দেশ ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগেই সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির দিকে মনোনিবেশ করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। এদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্লুু ইকোনমির সম্ভাবনাসমূহ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। গত জুনে জাতিসংঘে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের জন্য আয়োজিত ‘সমুদ্রতলের সম্পদে টেকসই উন্নয়ন ঘটিয়ে প্রাপ্ত সুবিধার ন্যায়সঙ্গত বণ্টন : স্বল্পোন্নত, ভূ-বেষ্টিত স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপ-রাষ্ট্রসমূহের সুযোগ’ শীর্ষক এক ব্রিফিং অনুষ্ঠানে এই সহযোগিতা চান জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা।
এরপর গত ২২ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরের বর্ধিত মহীসোপানে নিজেদের সীমা সংক্রান্ত সংশোধিত তথ্যাদি জাতিসংঘে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন ও সমুদ্রবিষয়ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দিমিত্রি গংচারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে মহীসোপান সীমা সংক্রান্ত সংশোধিত তথ্যাদি হস্তান্তর করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। আমাদের সামনে কী রয়েছে? বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন। বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি এবং বিভিন্ন প্রকার অর্থনৈতিক ও জৈব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে উৎপাদিত মোট ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন এসেছে সমুদ্র থেকে। এদিকে ‘সেভ আওয়ার সি’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। নানা প্রজাতির মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। উপকূলীয় অঞ্চলের ৫ লক্ষাধিক জেলের জীবন-জীবিকার জোগান আসে এই সমুদ্র থেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রাণিসম্পদ ছাড়াও ১৩টি জায়গায় আছে মূল্যবান বালু, ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এগুলোতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমেনাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইটের মতো মূল্যবান ধাতব উপাদান।
বাংলাদেশের নতুন পাওয়া সমুদ্রসীমা দেশের মূল ভূ-খন্ডের প্রায় সমান। অথচ দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের মাত্র ১৫.৪২% ভাগ অবদান সামুদ্রিক মাছের। এ সমুদ্র এলাকায় বছরে ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ রয়ে গেছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্লু ইকোনমির অবদান (বা গ্রস ভ্যালু এডেড) ছিল ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট অর্থনীতির মাত্র ৩ শতাংশ। এটি ছিল সমুদ্রসীমা অর্জনের পরপরই অপরিকল্পিত স্বাভাবিক অর্জন। সমুদ্র সীমানা নির্ধারিত হওয়ার পর ২৬টি নতুন ব্লকে বিন্যাস করে এর মধ্যে ১১টি অগভীর ও ১৫টি গভীর সমুদ্রের ব্লক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নতুন রপ্তানি পণ্য সামুদ্রিক শৈবাল : সুপারফুড খ্যাত সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। ব্লু-ইকোনমির বড় উপাদান হতে পারে এই সামুদ্রিক শৈবাল। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এ নিয়ে কাজ করছে। বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হচ্ছে এই সামুদ্রিক শৈবাল। সাগরে ১৩৮ প্রজাতির শৈবাল শনাক্ত হলেও এর মধ্যে ১৮টি রপ্তানিযোগ্য ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে লাভজনক। দেশে বর্তমানে পাঁচ হাজার টন সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদন হচ্ছে। বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদার কারণে সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদন বাড়াতে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বাজারজাত, গবেষণা ও প্রচারণায় গুরুত্ব দিয়েছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, শৈবাল নিয়ে চার বছর ধরে আমরা গবেষণা করছি। আমরা দেশের সব উপকূলীয় এলাকায় শৈবাল নিয়ে কাজ করব। ইতিমধ্যে পটুয়াখালীতে একটি গবেষণা ল্যাব বসানো হয়েছে। বিএফআরআইর ‘বাংলাদেশ উপকূলে সি-উইড চাষ এবং সি-উইডজাত পণ্য উৎপাদন গবেষণা’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মহিদুল ইসলাম বলেন, সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও আহরণে দক্ষ করে তুলতে কক্সবাজার ও কুয়াকাটায় ৩২০ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, উপকূলের মানুষের মাঝে এটি সম্প্রসারণ করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক প্রজাতির শৈবাল চাষ সম্ভব হবে। টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা গেলে অনন্তকাল এই সম্পদ আহরণ করা সম্ভব। শৈবালের পুষ্টিমান অন্যান্য জলজ প্রজাতির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ওষুধ তৈরিতেও এটি ব্যবহার হচ্ছে।
টুনা মাছ আহরণ প্রকল্প : ব্লু ইকোনমির অংশ হিসেবে টুনা মাছের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে সরকারের। এর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক এলাকার গভীর সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় টুনা ও সমজাতীয় মাছের প্রাপ্যতা যাচাই ও আহরণে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত করছে সরকার। এজন্য ৬১ কোটি ৬ লাখ টাকার প্রকল্প নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে গত জুলাইতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি সমগ্র চট্টগ্রাম জেলায় ২০২৩ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে ১. বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অংশে টুনা ও সমজাতীয় মাছের প্রাপ্যতা যাচাই ও আহরণ ২. গভীর সমুদ্র ও আন্তর্জাতিক জলসীমায় অনাহরিত টুনা ও সমজাতীয় মৎস্য আহরণের মাধ্যমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন। ৩. গভীর সমুদ্র হতে টুনা ও সমজাতীয় মৎস্য আহরণে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করা। এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, সাগরের টুনা মাছের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। দেশের বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সাগর থেকে আহরণের পর তা রপ্তানি করতে পারলে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে। বঙ্গোপসাগরের টুনা মাছ আহরণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই, তেমনি দক্ষ জনবলও নেই। এসব কারণেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে।
কতটা এগোলো বাংলাদেশ? বর্তমানে বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩২ বর্গকিলোমিটার। এই সমুদ্রসীমায় রয়েছে অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। কিন্তু বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ এখন পর্যন্ত প্রায় অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রসম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উল্লম্ফন ঘটবে।
দেশে প্রথম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। তারও আগে ১৯৭১ সালে কানাডীয় প্রযুক্তি সহায়তায় সেখানে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস (আইএমএস) কার্যক্রম শুরু করে। এই ইনস্টিটিউটের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বর্তমানে দেশে-বিদেশে সমুদ্র বিজ্ঞান পেশাজীবী হিসেবে কাজ করছে। ২০১১ সালে ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের একটি ডিসিপ্লিন হিসেবে ওশানোগ্রাফি বা সমুদ্রবিদ্যা বিষয়ে স্নাতকোত্তর খোলা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রথম বিভাগীয় সভাপতি ও সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট আয়তনের কাছাকাছি সমুদ্র অঞ্চল অর্জিত হয়েছে। তিনি বলেন, সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে ব্লুু ইকোনমি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দুই ধরনের সম্পদ অর্জন করেছে। এর একটি হলো প্রাণিজ আরেকটি হলো অপ্রাণিজ। প্রাণিজের মধ্যে রয়েছে, মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, আগাছা-গুল্মলতা ইত্যদি। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে চারটি মৎস্য ক্ষেত্র। সেখানে ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিনসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির শৈবাল রয়েছে। অপ্রাণিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে, খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদ যেমন, তেল, গ্যাস, চুনা পাথর ইত্যাদি। আরও রয়েছে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজ বালি। যেমন, জিরকন, রোটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিক্লোসিন ইত্যাদি। যার মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেসর ড. ইফতেখার চৌধুরী আরও বলেন, সমুদ্রসৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন। প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের ৮ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সঙ্গে দুটি অগভীর ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করেছে। এ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে গভীর ব্লক ১১ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সঙ্গে গভীর ব্লক ১২ এ চুক্তি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র সম্পদ আহরণে কার্যকর জরিপ-গবেষণা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ল্যান্ড-লকড দেশ যেমন, নেপাল আর ভুটানের যখন সমুদ্রে প্রবেশাধিকার দরকার হবে তখন তাদের পোর্ট সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশ, যা ব্লুু ইকোনমির অন্যতম অংশ। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, পলিসি লেভেলে কিছু অর্জন হয়েছে, যেমন মেরিটাইম এফেয়ার্স ইউনিট, যেটা সামগ্রিকভাবে মেরিটাইম রিসোর্স দেখছে। আর একটা হলো ব্লুু- ইকোনমি সেল গঠন, যার কাজ হচ্ছে, মাছ থেকে শুরু করে আরও যেসব অনাবিষ্কৃত সমুদ্র সম্পদ আছে সেগুলো কীভাবে পরিবেশবান্ধব করে সংগ্রহ করা যায় এবং কীভাবে সেগুলোর টেকসই ব্যবহার করা যায় তা খতিয়ে দেখা। অধ্যাপক ইয়াসমিন বলেন, কাজ সক্রিয়ভাবে শুরু করার জন্য যে রিসোর্স প্রয়োজন তা নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। কোস্টাল শিপিং, মেরিন মিনারেল মাইনিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পর্যটন শিল্পের ক্ষেত্র তৈরি ইত্যাদি কাজও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। কিন্তু সমুদ্র বিজয়ের পর গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এই দীর্ঘ সাত-আট বছরে তা কাজে লাগানো যায়নি। আমাদের মাছ ধরার ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৭০ কিলোমিটারের বেশি গভীরে গিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে পারে না। এর বাইরে আরও সাড়ে ৬০০ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র অঞ্চল আমাদের মাছ ধরার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।