নিউজ ডেস্ক:
বাংলাদেশের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়িয়ে যাচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপি ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে। পেছনে আছে পাকিস্তানও। এমন অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সাফল্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। এই অগ্রগতি নিয়ে বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমে চলছে আলোচনা ও চর্চা। ১ জুন (মঙ্গলবার) মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ-এ ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিহির শর্মা একটি কলামে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। মিহির শর্মা দিল্লিভিত্তিক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং প্রতিষ্ঠানটির অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধি কর্মসূচির প্রধান। তিনি ‘রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমিক’ বইয়ের লেখক এবং ‘হোয়াট দ্য ইকোনমি নিডস নাউ’ বইয়ের সহ-সম্পাদক। ‘সাউথ এশিয়া শুড পে অ্যাটেনশন টু ইটস স্ট্যান্ডআউট স্টার’ শিরোনামের লেখাটি বাংলা ট্রিবিউন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
অর্ধশত বছর আগে, ১৯৭১ মার্চ মাসে বাংলাদেশের জাতির জনক তাদের চেয়ে ধনী ও বেশি শক্তিশালী পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধে দেশটির জন্ম হয়েছে, লাখো মানুষ ভারতে পালিয়ে যায় অথবা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থক আমেরিকানদের কাছে নতুন দেশটির ব্যর্থতা অবশম্ভাবী ছিল। তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। জর্জ হ্যারিসন ও রবি শংকর প্রথমবারের মতো সহযোগিতা কনসার্ট আয়োজন করে দুর্দশায় পতিত দেশটিতে ইউনিসেফের ত্রাণ কাজের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।
মে মাসে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, গত বছর মাথাপিছু জিডিপি ৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার। অন্য দিকে, পাকিস্তানের মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৫৪৩। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি ধনী ছিল। আজ বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি ধনী। পাকিস্তানের এক অর্থনীতিবিদ হতাশার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, ‘২০৩০ সালে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের সহযোগিতা চাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে’।
দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতি হিসেবে আজীবন ভেবে আসা ভারতকেও এখন এই সত্যকে মেনে নিতে হবে, মাথা পিছু আয়ে তারা বাংলাদেশের চেয়ে গরিব। ২০২০-২১ সালে ভারতের মাথা পিছু আয় ছিল ১ হাজার ৯৪৭ ডলার।
বাংলাদেশের এই সাফল্যকে ভারত স্বীকৃতি দেবে ভেবে নিজেদের দম বন্ধ করবেন না। ভারতের জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিরা মনে করেন, বাংলাদেশ এতই নিঃস্ব যে দেশটি থেকে অবৈধ অভিবাসীরা দলে দলে সীমান্ত পার হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, ভারতের এসব হতাশাগ্রস্ত রাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি ধনী। এই রাজ্যগুলোতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা বাংলাদেশি ‘কীটের’ বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করছেন। অবস্থাটা যেন এমন– কানাডা থেকে অবৈধ অভিবাসীদের আসা নিয়ে উদ্বিগ্ন মিসিসিপি।
হয়তো এটিই ব্যাখ্যা করে কেন- জিডিপির সংখ্যা ঘোষণার পর ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ক্রোধ ও অস্বীকারে ফেটে পড়ে। এদিকে, বাংলোদেশি সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে খুব কম তুলনা করা হয়েছে। এটি একটি আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ, যা ধারাবাহিক অগ্রগতি থেকে আসে।
বাংলাদেশের অগ্রগতির তিনটি ভিত্তি রয়েছে: রফতানি, সামাজিক অগ্রগতি ও রাজস্ব নীতি। বিশ্বের ০.৪ শতাংশের তুলনায় ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে প্রতিবছর ৮.৬ শতাংশ। এই সাফল্য এসেছে মূলত তুলনামূলক সুবিধা থাকা পোশাকের মতো পণ্যে নিরলস মনোনিবেশ ধরে রাখায়।
ভারত ও পাকিস্তানে কমলেও শ্রম শক্তিতে বাংলাদেশের নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারি ঋণ ও জিডিপির অনুপাত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বজায় রেখেছে। মহামারির পর ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৯০ শতাংশের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। ব্যয় সংকোচনের কারণে বাংলাদেশের বেসরকারি খাত আরও বেশি ঋণ ও বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের সফলতার সঙ্গে এসেছে নিজস্ব কিছু সমস্যাও। এর একটি হলো উন্নত দেশগুলোয় শুল্ক-মুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল দেশটি। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সের (জিএসপি) আওতায় শুল্ক-মুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল ঢাকা। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোই কেবল এই সুবিধা পেয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নত হয়ে ওঠায় ২০২৬ সাল কিংবা তার পর থেকে আর এই সুবিধা পাবে না।
এছাড়া অর্থনীতি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠায় এর তুলনামূলক সুবিধাতেও পরিবর্তন আসবে। ভিয়েতনাম এবং অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও রফতানি পণ্য গার্মেন্টস থেকে আরও বেশি মূল্যের কোনও পণ্যের ওপর জোর দিতে হবে। অন্য দেশগুলোর মতো এই পরিবর্তনও বাংলাদেশকে পরীক্ষায় ফেলবে।
আগামী এক দশকের জন্য সরকারের একটি কৌশল প্রণয়ন করার দরকার। যাতে বৈশ্বিক সংহতিকরণের নতুন ধরণ এবং অর্থনীতির অব্যাহত পরিবর্তন প্রাধান্য পাবে। সবচেয়ে স্মার্ট উপায় হলো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ওইসব দেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা। বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু আরও অনেক কিছুই করতে হবে।
আরও একবার বাংলাদেশের উচিত হবে ভিয়েতনামকে নিজেদের আদর্শ ধরে নেওয়া। ভিয়েতনাম কেবল চীনকেন্দ্রিক আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক সহযোগিতার অংশ নয়, তারা ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপেও আগে যোগ দিয়েছে। এসবের পাশাপাশি তারা ২০১৯ সালেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য এই পরিবর্তনগুলো সহজ হবে না, সেই কারণে প্রচেষ্টাগুলো এখনই শুরু করতে হবে। ঢাকাকে এখনই নিজেদের দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে: এর বিশেষ কারণ হলো তাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনও নিবেদিত ট্রেড নেগোশিয়েটর নেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি অনেক দূরবর্তী ছিল। আজ ভ্যাটিকান সিটির চেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ১৬ কোটির বেশি মানুষের উর্বর ব-দ্বীপের দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার সফলতার অন্যতম উদাহরণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।