নিউজ ডেস্ক:
ব্রিকসকে বিশ্বের বহুমুখী বাতিঘর হতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এই বহুমুখী বিশ্বে ব্রিকসকে একটি বাতিঘর হিসেবে প্রয়োজন। আমরা আশা করি, এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফরম হিসেবে আবির্ভূত হবে। আমাদের শিশু ও যুবকদের কাছে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে আমাদের জাতিগুলো সংকটে পড়তে পারে, কিন্তু কখনোই পরাজিত হবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ব্রিকস’-এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাও এই সংলাপে বক্তব্য দেন। ব্রিকস প্লাস ডায়ালগের ফাঁকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, উগান্ডার ভাইস প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার উপপ্রধানমন্ত্রী, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুশল বিনিময় করেন।
প্রধানমন্ত্রী ১৫তম ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গে আসা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে একটি ফটো সেশনেও যোগ দেন।
গ্লোবাল সাউথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত পছন্দ ও বিভাজনকে ‘না’ বলা উচিত। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টানিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে।
” তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সবাইকে সব ধরনের হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে এসে বিশ্বব্যাপী জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে শান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাইকে একসঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং জলবায়ু, ন্যায়বিচার, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইকুইটি এবং ঋণ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগসহ নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা সংরক্ষণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান ব্রিকস চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার আমন্ত্রণে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে গত ২২ আগস্ট জোহানেসবার্গে পৌঁছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস দেশগুলোর ঐতিহাসিক ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করেছে। এর সদস্য দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা ডা সিলভা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ইউএনজিএতে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উদীয়মান বিশ্বে আমাদের জন্য, আমাদের ভাগ্য ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আমাদের নিজেদের সামর্থ্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে।’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) ৫০ বছর আগে যে বার্তা দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তা এখনো সত্য বলে মনে করেন।
প্রধানমন্ত্রী রামাফোসাকে তাঁর আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার স্নেহ ও আশীর্বাদ উপভোগ করার জন্য আমি দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযুক্তি অনুভব করছি। আমি ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫তম বার্ষিকীতে আমাদের উদযাপনে তাঁর যোগদানের কথা স্মরণ করছি।’
ম্যান্ডেলার মতো বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জাতির জন্য ত্যাগের জীবন যাপন করতেন, তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি ১৩ বছরেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন।
তিনি বলেন, “গত সপ্তাহে আমরা ১০০ মিলিয়ন মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছি, যেখানে সব লেনদেন অনলাইনে হয়। সরকারি কর্মীরা পেনশন সুবিধা ভোগ করে। আমাদের সরকারের পরবর্তী লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা।”
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছে—এ কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে বাংলাদেশের শেয়ারের যথেষ্ট যোগ্যতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অবকাঠামো, শিল্প ও ক্লিন জ্বালানি খাতে আমাদের বিনিয়োগকে সমর্থন করার জন্য সম্ভাব্য অর্থায়নের প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আর্থিক নীতি ব্যবস্থাপনা সংস্কারের জন্য অপেক্ষা করার সময় আমাদের অবশ্যই কার্যকর বিকল্প থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে চ্যাম্পিয়ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত থাকতে পেরে বাংলাদেশ গর্ববোধ করে।
মিয়ানমার থেকে ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আফ্রিকায় শরণার্থী-আশ্রয়দানকারী দেশগুলো এর ভার বুঝতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের থিম্যাটিক অ্যাম্বাসাডর এবং অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিস-অর্ডার জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
নারীদের পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রীর ৫ দফা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী ও বালিকাদের পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ব্রিকস সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসডিজি ৫ অর্জনের জন্য আমাদের সবার হাতে হাত রেখে চলা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম প্রস্তাবে বলেন, ‘আমাদের নারী ও মেয়েদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান খাদ্য, শক্তি ও আর্থিক সংকটের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করতে হবে।’
দ্বিতীয়ত, মেয়েদের স্কুলে রাখতে, তাদের সাইবার অপরাধ থেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিভাজন কমানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তৃতীয়ত, নারীদের লাভজনক কর্মসংস্থান, শালীন কাজ, মজুরিসমতা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়াতে হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী একটি সক্রিয় ও টেকসই রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়তে নারীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পাশাপাশি জলবায়ুর প্রভাবের কারণে নারীদের সুরক্ষা ও টিকে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর গভীরভাবে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্র : বাসস