নিউজ ডেস্ক:
সরকারি চাকুরেদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল (তথ্য ভান্ডার) তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর আলাদাভাবে চাকরি জীবনের বিভিন্ন স্তরের কর্মদক্ষতা, ব্যক্তিগত ও পেশাগত মূল্যায়নের তথ্য থাকবে। এটা হবে সংশ্লিষ্ট চাকুরের চাকরি জীবনের ‘আমলনামা’।
এই আমলনামার ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি ও পদায়ন। এ সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এটি কার্যকর হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাৎসরিক গোপন প্রতিবেদনের (অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট বা এসিআর) পরিবর্তে চালু হবে (অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট বা এপিএআর)। বর্তমানে এসিআরের সময়কাল জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর হলেও এপিআরএ সময়কাল হবে অর্থবছরকেন্দ্রিক অর্থাৎ জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করতে এবং প্রশাসনের পদোন্নতি ও পদায়নে শৃঙ্খলা আরও মজবুত করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য সব সরকারি চাকুরের আলাদাভাবে ব্যক্তিগত প্রোফাইল তৈরি করা হচ্ছে। ওই প্রোফাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার চাকরি জীবনের সব ধরনের তথ্য থাকবে। ফলে তার পদায়ন ও পদোন্নতিতে এ তথ্যভান্ডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া সরকারি চাকুরেদের এসিআরের বদলে শিগগিরই এপিএআর চালু করা হবে। মূলত যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্য জায়গায় পদায়ন ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতেই এই উদ্যোগ।’
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এপিএআর চালু হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার প্রোফাইলের ভিত্তিতে তাকে বাছাই করা সম্ভব হবে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করে কার্যকর করা হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ২১ হাজার ২৮৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ জন কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর অ্যানুয়াল কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট বা এসিআর পদ্ধতি নিয়ে অনেক অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসিআরের বদলে এপিএআর চালু করতে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অষ্টম বৈঠক জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত হয়। কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন প্রসঙ্গে বৈঠকে কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান বলেন, যিনি উপযুক্ত ও যোগ্য তিনি যেন সময়মতো পদোন্নতি পান, অযোগ্য কর্মকর্তারা যেন পদোন্নতি না পান সেটিও যেন নিশ্চিত করা হয়। কোনো কর্মকর্তা যেন পদোন্নতির পেছনে না ঘুরে বরং পদোন্নতিই যেন কর্মকর্তার পেছনে ঘুরে সেভাবে কাজ করতে হবে। তিনি কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও নিয়োগকৃত পদ ও যথাসময়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পদ সৃজনসহ পদোন্নতির প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন করার পরামর্শ দেন। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, বর্তমানে কর্মচারীদের পদোন্নতির বিষযে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সব কর্মচারীর প্রোফাইল তৈরি করা হচ্ছে। যাতে করে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি জীবনের বিভিন্ন স্তরের কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন, ব্যক্তিগত ও পেশাগত মূল্যায়নের মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়া যায়। সে হিসেবে এপিএআর সিস্টেম চালু করা হবে। জানা গেছে, বর্তমানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে এসিআরের আকাক্সিক্ষত মূল্যায়ন পেতে অধস্তনদের চিন্তার অন্ত থাকে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা ‘বস’ যা বলেন এসিআরে তাই চূড়ান্ত। গোপনীয় প্রতিবেদনে ‘বস’ কী মূল্যায়ন করলেন জানারও উপায় নেই। এর ঠিক উল্টা বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসিআরের বদলে অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট (এপিএআর বা বাৎসরিক কর্ম মূল্যায়ন প্রতিবেদন) প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। বর্তমান এসিআরের পুরোটাই ব্যক্তিগত ও পেশাগত বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন হয়। যেমন-ব্যক্তিত্ব, সময়ানুবর্তিতা, সততার ইত্যাদির মতো ২৫টি মানদন্ড আছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বছরব্যাপী কী কাজ করলেন, করলে ঠিকমতো করেছেন কিনা সেটার মূল্যায়ন নেই। অর্থাৎ বিদ্যমান এসিআরের ১০০ নম্বরের পুরোটাই বৈশিষ্ট্যনির্ভর। কিন্তু এপিএআরে কর্মচারীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের নম্বর থাকে ৪০। এপিএআরকে অ্যানুয়েল পারফরম্যান্স অ্যাগ্রিমেন্টের (এপিএ) সঙ্গে যুক্ত করে মূল্যায়ন করা হবে। প্রত্যেক কর্মচারীর নিজস্ব অর্জন ও প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন মিলিয়ে এপিএআর নির্ধারণ হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, এপিএআর চালু হলে স্বজনপ্রীতি বা কারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকবে না। অফিসারের পরিচয় হবে তার প্রোফাইল। অনেকে আছেন দীর্ঘদিন মাঠ প্রশাসনে ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন অফিসাররা না চেনায় মূল্যায়ন হয় না। এপিএআর পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে এ ধরনের সমস্যা থাকবে না। কাজের ভিত্তিতে সরকারি চাকুরেরা নিজেরাই নিজেদের মূল্যায়ন করতে পারবেন। এতে করে দেশব্যাপী সরকারি কর্মচারীদের জবাবদিহি বাড়বে। এপিএআর হবে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীর জন্য একটি করে অনলাইন অ্যাকাউন্ট হবে। এতে চাকরিতে ঢোকার প্রথম দিন থেকে শেষ দিনের প্রয়োজনীয় তথ্য থাকবে। অ্যাকাউন্টে কর্মচারীরর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির আপডেট থাকবে, কে কতবার বিদেশ সফরে গেছেন, কোন কোন দেশে গেছেন এসব তথ্য থাকবে। পরবর্তী সময়ে ওইসব দেশ সম্পর্কিত কাজের জন্য সহজেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুঁজে পাবে সরকার। একইসঙ্গে তথ্য গোপন ও অন্যদের বঞ্চিত করে বারবার বিদেশ সফরে যেতে পারবে না কেউ।