রবিবার , ডিসেম্বর ২২ ২০২৪
নীড় পাতা / জাতীয় / বুড়িগঙ্গায় মিলছে মাছ

বুড়িগঙ্গায় মিলছে মাছ

নিউজ ডেস্ক:
বুড়িগঙ্গার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উৎকট ঝাঁজালো গন্ধের নোংরা কালো পানির এক নদীর চেহারা। তবে বর্তমানে পাল্টে গেছে এ দৃশ্য। কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরেছে ঢাকার জন্মদাত্রী বুড়িগঙ্গায়। এ নদীর পানি এখন বেশ স্বচ্ছ। কমেছে দুর্গন্ধ আর দূষণ, বেড়েছে অক্সিজেনের পরিমাণও। নদীর বিভিন্ন জায়গায় জাল-বড়শি দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যও চোখে পড়ে প্রতিদিন। শরতের এই সময়ে এখন নদীতীরে গেলে প্রাণ জুড়িয়ে যায় নির্মল বাতাসে, যা গত দুই যুগে ভাবাই যায়নি।

‘বুড়িগঙ্গার সন্তান’ ঢাকার বয়স ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। বাকল্যান্ড বাঁধের তীরে গড়ে ওঠা এই শহরের উন্নয়নের জঞ্জাল বুড়িগঙ্গাকে ধ্বংস করেছে তিলে তিলে। গত দুই দশকে এর দূষণ পৌঁছেছে বিপজ্জনক পর্যায়ে। দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা নেমে গিয়েছিল ১ দশমিক ০২ মিলিগ্রামে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন পানিতে মাছ তো দূরের কথা কোনো প্রাণের অস্তিত্ব থাকাও অসম্ভব। কিন্তু বর্ষা এবং লকডাউনে অনেকটা বদলে গেছে সেই পানির রঙ ও গন্ধ। অক্সিজেনের মাত্রা পৌঁছেছে ৪ মিলিগ্রামে, যা গত কুড়ি বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বদলে যাওয়া পানিতে সদরঘাট টার্মিনাল এলাকায় ঝাঁপ দিয়ে শৈশবের দুরন্তপনায় মেতে উঠতে দেখা গেছে শিশুদের। এ যেন বুড়িগঙ্গারই ‘শৈশবে’ ফিরে যাওয়া।

বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুর, সদরঘাট, সোয়ারিঘাট, কামরাঙ্গীরচর হয়ে বছিলা ব্রিজ পর্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, পানিতে এখন আগের মতো দুর্গন্ধ নেই, পানির ঘন কালো রঙ উধাও। আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও টলমলে। নদীর অনেক জায়গায় জাল দিয়ে মাছ ধরছে নদীতীরের বাসিন্দারা। পাওয়াও  যাচ্ছে নানা জাতের ছোট ও মাঝারি মাছ। নদীর পানি হাতে তুলে নিলে বোঝার উপায় নেই এটা বুড়িগঙ্গা নাকি মেঘনার পানি।

স্থানীয়রা জানায়, পানি বদলে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গায় মাছ আসতে শুরু করেছে। সদরঘাট ও বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় কয়েকজনকে জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে। শ্যামপুরে বড়শি দিয়েও মাছ ধরছিলেন কয়েকজন। 

এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা নৌকার মাঝি ইস্কান্দার (৫০) সময়ের আলোকে বলেন, ‘গত ২৫ বছরেও বুড়িগঙ্গায় এমন ভালো (স্বচ্ছ) পানি দেখিনি। আগে তো নদীতে নৌকা নিয়ে নামলে গন্ধে বমি চলে আসত। এখন তেমন কোনো গন্ধ নেই। বাবুবাজার ব্রিজের নিচে তো দেখলাম জাল দিয়ে মাছ ধরতে। এটা আগে চিন্তাও করা যায়নি।’ তবে বুড়িগঙ্গার তলদেশে এখনও ময়লার স্তূপ। নদীতে জাল ফেলার পরে জালের সঙ্গে এখনও ভেসে ওঠে দুই দশক ধরে জমতে থাকা ময়লা।

কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা কলেজছাত্র মো. মোবিন বলেন, ‘কাজ না থাকলে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসতাম না গন্ধের কারণে। এখন কোনো গন্ধ নেই।’

ঢাকা-বরিশাল রুটের বিলাসবহুল পারাবত লঞ্চের স্টাফ আজিজ মিয়া বলেন, ‘ঘাটে (সদরঘাট) এলে এখন বোঝার উপায় নেই এটা বুড়িগঙ্গা নাকি কীর্তনখোলা নদী (বরিশাল)। আগের মতো গন্ধ নেই। পানিও আগের চেয়ে অনেকটা পরিষ্কার। এরকম সব সময় থাকলে হয়।’

এদিকে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নিয়ে যা ঘটছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। দিন, মাস, বছর থেকে এখন দশক পার হলেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানিদূষণ রোধে সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর হয়নি। আদালত দায়িত্বপ্রাপ্তদের তলব করছেন, তিরস্কার করছেন এবং অসন্তোষও প্রকাশ করছেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কাজ হয়েছে অনেক কম। এখনও মানববর্জ্যরে পাশাপাশি কিছু শিল্পবর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, ইটভাঁটা, পলিথিন ইত্যাদির গন্তব্য বুড়িগঙ্গা। বিআইডব্লিউটিএ’র এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গায় ৬৮টি স্যুয়ারেজ সংযোগ রয়েছে, এর ৫৬টিই ওয়াসার। 

বুড়িগঙ্গা নদীর পানিদূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১০ সালে রিট আবেদন করা হয়। ২০১১ সালের ১ জুন তিন দফা নির্দেশনাসহ রায় দেওয়া হয়। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন (স্যুয়ারেজ) ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের লাইন ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করতে বলা হয়। নির্দেশনাগুলো এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে কিছু কিছু নির্দেশ বাস্তবায়ন হওয়ায় দূষণ কিছুটা কমেছে বলে মনে করছেন রিটকারী সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এইচআরপিবির প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ। 

তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘কেরানীগঞ্জ ও শ্যামপুরের কলকারখানার বর্জ্য এবং নদীতীরে বসবাসকারী মানুষের বর্জ্য বুড়িগঙ্গার দূষণের অন্যতম কারণ। বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা কেরানীগঞ্জ ও শ্যামপুরের বেশ কিছু কারখানায় সম্প্রতি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তাদের ইটিপি স্থাপনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে দূষিত বর্জ্য নদীতে পড়া অনেকটাই কমে আসে। সম্প্রতি একটি আদালত অবমাননার রুলের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ওয়াসা বুড়িগঙ্গায় তাদের স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এসব কারণে গত দুই বছরে বুড়িগঙ্গার দূষণ কিছুটা কমেছে। এখন মাছও পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের সংবাদ।’ 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম সময়ের আলোকে বলেন, ‘বর্ষা ও লকডাউন ছাড়াও সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের কারণে বুড়িগঙ্গার পানি এখন স্বচ্ছ। এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো খবর। এখন এ অবস্থা যেকোনো উপায়ে ধরে রাখতে হবে।’

এদিকে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় স্টামফোর্ডের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণার ফলাফল বলছে, গত জুন মাস থেকে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন বেড়েছে। নদীর বছিলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে পুরান ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়। ক্যাপস জানায়, ২০১৯-এর ডিসেম্বর ও এপ্রিল ২০২০-এর তুলনায় আগস্ট ২০২১-এ বুড়িগঙ্গার পানির মান ভালো হয়েছে। পানির মান নির্ণয়ে অন্যতম একটি নির্দেশক হচ্ছে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের গড় মান ছিল প্রতি লিটারে ১ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম, যা ২০২০ সালে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮। যদিও এটা বাংলাদেশের আদর্শ মাত্রার চেয়ে প্রায় তিন থেকে চারগুণ কম। তবে ২০২১ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত গড় অক্সিজেন পাওয়া গেছে ৪ দশমিক ২৬ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান প্রায় দুই দশমিক ৫ গুণ ভালো পাওয়া গেছে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। সংস্থাটি আরও জানায়, বুড়িগঙ্গার পানিতে ২০১৯ ও ২০২০ সালে পানির ঘোলাত্বের মানও আদর্শ মানের চেয়ে প্রায় এক থেকে তিনগুণ খারাপ ছিল। তবে ২০২১ সালে এসে পানির ঘোলাত্বের মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। আগস্টে বুড়িগঙ্গার পানিতে গড় ঘোলাত্বের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫ এনটিইউ, যা আদর্শ মানের (১০ এনটিইউ) মধ্যে রয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানি গত দুই বছরে তিন থেকে চারগুণ বেশি পরিষ্কার হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর এবং বুড়িগঙ্গা রিভার কিপার শরীফ জামিল সময়ের আলোকে বলেন, ‘মৃতপ্রায় একটি নদী বুড়িগঙ্গা। দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে নদীটি। মানুষের শরীরের মতো বুড়িগঙ্গার শরীরে বেশ কিছু টিউমার ও ক্যানসার রয়েছে। টিউমার আর ক্যানসারের উৎস হচ্ছে বর্জ্য নিষ্কাশনের লাইন দিয়ে প্রবাহিত দূষিত তরল। এ ছাড়া নদীটি দখল হচ্ছে। দখল যদি দূর করা যায়, তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমে আসবে। তবে বেশ কয়েকবারের লকডাউন ও বর্ষা মৌসুম হওয়ার কারণে নদীর পানির মানের বেশ উন্নতি হয়েছে। পানির লবণাক্ততা ও ভাসমান বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণার পরিমাণ গত বছরের তুলনায় কমেছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় পানির রঙ অনেকটা ভালো, গন্ধও কমে গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘নদী একটি জীবন্ত সত্তা এবং এর দেখভালের জন্য একজন অভিভাবক রয়েছে, যার নাম জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু নদীর পানির স্বাস্থ্য দেখার মতো কেউ নেই। বুড়িগঙ্গার বর্তমান গন্ধহীন স্বচ্ছ পানি সব সময় পেতে হলে নদী পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। এ জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়ে নদী রক্ষা আইনকে শক্তিশালী করতে হবে সরকারকে।’

ক্যাপসের গবেষণা পর্যবেক্ষণ প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা নদীর পানির মান ভালো করার জন্য গবেষকদের ভূমিকা অপরিসীম। একই সঙ্গে সরকারের পূর্ণ সহায়তা ও সদিচ্ছাও জরুরি।’ 

তিনি বলেন, ‘নদী ও নদীর পাড় থেকে অবৈধ দখল, শিল্পবর্জ্য শোধনে ইটিপি/সিইটিপি ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ নৌযান মেরামত ও নৌযানে পয়ঃপ্রণালীর আধুনিকায়ন, নদীতে শহরের বর্জ্য ছাড়ার আগে স্ক্রিনিং পদ্ধতিতে কঠিন বর্জ্য অপসারণ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই বুড়িগঙ্গার আগের রূপ স্থায়ীভাবে ফিরে পাওয়া সম্ভব।

আরও দেখুন

লালপুরে কুরেছান বেগমের ইন্তেকাল 

নিজস্ব প্রতিবেদক লালপুর,,,,,,,,,,,,,,দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার নাটোরের লালপুর প্রতিনিধি ও মডেল প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সাহীন …