নিউজ ডেস্ক :
আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস
*উচ্চ পেশাদারিত্ব এবং মানবিক আচরণে আস্থা ও মর্যাদা অর্জন করেছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা: ড. দেলোয়ার হোসেন *দেশের সম্মানের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন: পরিচালক, আইএসপিআর
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পৃথিবীর গোলোযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী হিসেবে এখন রোলমডেল। জাতিগত ও আঞ্চলিক সংঘাত মোকাবিলা করে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে শান্তিস্থাপনে অনন্য অবদান রেখে চলেছেন তারা। ভিন দেশে গিয়েও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী এবং পুলিশের গর্বিত এ শান্তিরক্ষীরা তাদের উচ্চ পেশাদারিত্ব ও মানবিক কর্মকাণ্ড দিয়ে দেশকে বিশ্ব দরবারে অনন্য সম্মান ও মর্যাদায় নিয়ে গেছেন। ওইসব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী নিজের জীবনটিও উৎস্বর্গ করেছেন। এছাড়া গুরুতর আহত হয়েছেন ২৬৬ জন।
আজ সেই ২৯ মে, আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও নানা বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় এবং আহত শান্তিরক্ষীদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ উপস্থাপনার আয়োজন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন গোলোযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে আসছে। সর্বোচ্চ সুনামের অধিকারী হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ এখন অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। যা এর আগেও একাধিকবার শীর্ষ অবস্থানে ছিল। মূলত, বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের উচ্চমানের পেশাদারিত্ব এবং মানবিক আচরণের মাধ্যমেই এই আস্থা ও মর্যাদা অর্জন করেছে। যা শান্তিরক্ষীদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষন করলেও দেখা যায়।
কঙ্গোতে (মুনস্কো) শান্তিরক্ষা মিশনের পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে ড. দেলোয়ার হোসেন আরো বলেন, কঙ্গোতে গিয়ে দেখেছি- কিভাবে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সেখানকার স্থানীয় মানুষদের কাছে প্রিয়জনে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে শান্তিরক্ষীরা সেখানে নিয়োজিত ছিলেন তাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের দারুণ একটা সম্পর্ক দেখেছি। এই চিত্র প্রায় সবখানেই। এমনকি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা পৃথিবীর বিভিন্ন গোলোযোগপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সারা জীবনের জন্য অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু হায়দার মোহাম্মদ রাসেলুজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব শান্তিতে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষীদের ভূমিকা বা অবদান সবসময় প্রশংসিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এ জন্যই আমরা দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ শান্তিরক্ষী বা অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছি। এ জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে শান্তিরক্ষীর একটা ‘ব্রান্ড’ বা রোলমডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।’
লেফ. কর্নেল রাসেলুজ্জামান আরো বলেন, ‘বর্তমান সময়ে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সশস্ত্র সংঘাতের বিবর্তন, শান্তিরক্ষীদের উপর হামলা হচ্ছে, ‘ম্যানডেট’ অনুযায়ী দায়িত্বের পরিধি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধিসহ পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে। এমন সব পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে দেশের সম্মানের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।’
জানা যায়, ১৯৮৮ সালে তৎকালীন ইরাক-ইরান যুদ্ধ বিরতির অবস্থায় মধ্যস্ততাকারী সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের হয়ে প্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন কর্মকর্তা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী (পর্যবেক্ষক) হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরের বছর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেয় বাংলাদেশ পুলিশ। এর পরপরই গোলোযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে থাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ পুলিশ। সময়ের প্ররিক্রমায় লাল-সবুজের বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা এখন বিশ্বে রোলমডেল। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বমোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর জানান, ১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের শান্তিরক্ষা মিশন শুরু হয়। এ পর্যন্ত পুলিশের ২১ হাজার ৪৫৩ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন। এরমধ্যে নারী পুলিশ শান্তিরক্ষী রয়েছেন ১ হাজার ৮১০ জন। বর্তমানে ছয়টি দেশে পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্যসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিযুক্ত আছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ২৪ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেন। আহত হন ১২ জন।
আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসের কর্মসূচী:
আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবসটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সকল দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উদযাপনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় এবং আহত শান্তিরক্ষীদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে সকালে শান্তিরক্ষীদের স্মরণের মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। যেখানে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে ‘শান্তিরক্ষী দৌড়-২০২৪’ উদ্বোধন করবেন।
আইএসপিআর জানায়, দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরার লক্ষ্যে বিশেষ জার্নাল ও জাতীয় দৈনিকসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে বিশেষ টক-শো প্রচারিত হবে। এছাড়াও শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের কার্যক্রমের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হবে।