নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইতিহাসের দায়মোচন না নতুন ইতিহাস, সে বিতর্ক থাকতেই পারে। দায়মোচনেই সৃষ্টি হয় নতুন ইতিহাস। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষদের জীবন বদলে ফেলার নতুন স্বপ্ন দেখানোর মাধ্যমে নতুন ইতিহাসই সৃষ্টি করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে আজ এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির দিন। বিশে^র সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। মুজিব বর্ষের উপহারস্বরূপ দেশের গৃহহীনদের পাকা বাড়ি করে দেওয়ার প্রথম পর্যায়ে আজ সেই বাড়ি হস্তান্তর করা হবে ৭০ হাজার পরিবারের মধ্যে। চোখে-মুখে উচ্ছ¡াস সুবিধাভোগীদের। আনন্দ হিল্লোল বইছে মুজিব গ্রামগুলোতে।
একে একে ইতিহাস সৃষ্টি করা শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ায় ছিটমহল বিনিময় করে অনেকের পরিচয় করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশি হিসেবে। এবার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন তাদের অনেককে।
ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দা আলীফ উদ্দিন (৬২)। তিনি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের সময় দাসিয়ারছড়ায় থেকে গিয়েছিলেন। ভারতের নন,
বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই মাটিতে আমৃত্যু থেকে যেতে চেয়েছিলেন। আর তার এই বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর আলীফ উদ্দিনকে স্থায়ী আশ্রয়ও করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। ফুলবাড়ী ইউনিয়নের কামালপুরে (সাবেক দাসিয়ারছড়া) অন্য ১৩ জন ভ‚মিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মতো আলীফ উদ্দিনকে সুদৃশ্য গৃহ উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আলীফ উদ্দিন তাই বললেন, ওপরে আল্লাহর রহম, নিচে শেখ হাসিনার দয়া। তাই নতুন বাংলাদেশে ভালো আছি। নাগরিকত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা, আশ্রয়ও দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
শুধু আলীফ উদ্দিনই নন, ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবার আজ শনিবার পাচ্ছেন তাদের স্থায়ী ঠিকানা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে দেশের ভ‚মিহীন ও গৃহহীন ৯ লাখ পরিবারের মধ্যে প্রথম ধাপের এই ৬৬ হাজার ১৮৯টি পরিবারের হাতে জমি ও ঘরের মালিকানার কাগজ তুলে দেবেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।
এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জমি ও ঘর হস্তান্তর কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উ™ে^াধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে ৭৪৩টি ব্যারাকে ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে পুনর্বাসনও করা হবে। অর্থাৎ এই ধাপে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে ঘর দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে একক গৃহ এবং ব্যারাকে মোট ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভ‚মিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার ঘটনা বিশে^ এটাই প্রথম। বিশে^র ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধনের মাধ্যমে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশে পরিণত হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
সাবেক দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে স্থাপিত ভ‚মিহীন ও গৃহহীনদের নতুন নিবাসে সপরিবারে ঠাঁই মিলেছে আলীফ উদ্দিন ছাড়াও আবদুস সালাম (৬৫), আক্তার আলী (৫২) এবং স্বামী পরিত্যক্ত মুক্তা বেগমেরও (২৫)। এই চারজনই জন্মভিটা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাননি। এখন শেখ হাসিনার উপহার সুদৃশ্য গৃহ পেয়ে খুবই উচ্ছ¡সিত। তারা অভিন্ন ভাষায় বললেন, নতুন বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে শেখ হাসিনার জন্য শত কোটি দোয়া করছি।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের খাটামারি গ্রামের ভ‚মিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর জন্য নির্মিত নিবাসে ঠাঁই পেয়েছেন বয়োবৃদ্ধা দেলু বেগম (৯০)। এর আগে তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি ভাঙা ঘরে আশ্রয় নিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘যিনি তাদের ঘর করে দিয়েছেন, সেই শেখ হাসিনার জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করব। আল্লাহ খুশি, শেখ হাসিনা খুশি, আমরাও খুশি।’ একই নিবাসের সমস্তভান বেগম (৫৮) জানান, তারও কোনো ঘরদুয়ার ছিল না। গত ২৮ বছর ধরে তিনি মানুষের বাড়িতে পড়েছিলেন। শেখ হাসিনা তাকে ঘর দিয়েছেন, স্থায়ী ঠিকানা দিয়েছেন।
একই জেলার নাগেশ^রী উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের চর বেরুবাড়ী গ্রামে ঘর পেয়েছেন ৭০ বছর বয়সি বিধবা লালবানু। তিনি বলেন, ‘মানুষের সাহায্য নিয়ে চলতাম, মানুষের বাড়িতে থাকতাম। আল্লাহয় দিছে, আর শেখ হাসিনায় দিছে ঘর।’
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, ‘মুজিব বর্ষ’ উপলক্ষে ‘আশ্রয়ণের অধিকারÑ শেখ হাসিনার উপহার’ সেøাগানকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলার নয়টি উপজেলায় মোট ১ হাজার ৫৪৯টি গৃহহীন ও ভ‚মিহীন পরিবার প্রথম ধাপে দুই শতাংশ জমিসহ ঘর পাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ভ‚মিহীন ও গৃহহীনই মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগের আওতায় আসবেন।
গৃহহীন ও ভ‚মিহীনদের স্থায়ী ঠিকানা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প প্রথম পর্যায়ের ৬৬ হাজার ১৮৯টি একক গৃহ নির্মাণের সামগ্রিক কাযত্রক্রম সমন্বয় করছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে একক গৃহগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় যেসব পরিবার গৃহ পাচ্ছে, সেসব পরিবারকে দুই শতাংশ খাস জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত সব গৃহের নকশা একই রকম হচ্ছে। প্রতিটি গৃহে ইটের দেওয়াল, কংক্রিটের মেঝে এবং লাল, নীল ও সবুজ রঙের টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি দুটি করে শোয়ার ঘর, একটি রান্নাঘর, টয়লেট এবং সামনে খোলা বারান্দা থাকবে। গৃহপ্রতি ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এ হিসাবে গৃহহীনদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ১ হাজার ১৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন বলেছেন, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রæতি পূরণে মোট ৯ লাখ পরিবারকে ঘর দেওয়া হবে। এর প্রথম ধাপে আজ শনিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৬৯ হাজার ৯০৪টি পরিবারকে গৃহ হস্তান্তর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সরকারের হিসাব মতে, সারা দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভ‚মিহীন ও গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১ লাখ ২৯ হাজার ১৯৭, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬ হাজার ৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৯৭, রংপুর বিভাগে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৪, রাজশাহী বিভাগে ৯৬ হাজার ৫০৪, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ৪২ হাজার ৪১১, বরিশাল বিভাগে ৮০ হাজার ৫৮৪ এবং সিলেট বিভাগে ৫৫ হাজার ৬২২টি গৃহহীন পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে জমি ও ঘর নেই, এমন পরিবারের পাশাপাশি ১০ শতাংশ জমি আছে; কিন্তু বাড়ি জরাজীর্ণ, এমন পরিবারও রয়েছে। মুজিব বর্ষে এই প্রায় ৯ লাখ পরিবারই পর্যায়ক্রমে গৃহ পাচ্ছে। যার সূচনা ঘটছে শনিবার প্রথম ধাপের ৬৯ হাজার ৯০৪টি গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে।