বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তির অন্যতম উৎস মাছ। মাছ চাষে দেশের অগ্রগতি ও অর্জন অভূতপূর্ব। অভ্যন্তরীণ ও চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে। বৈদেশিক মুদ্রা আসছে হাজার হাজার কোটি টাকা। করোনা ও বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির মধ্যেও মাছ রপ্তানি করে সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মৎস্য খাত থেকে আয় হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ধারা অব্যাহত রেখে রপ্তানি আরও বাড়াতে নানান উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
জানা যায়, বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। সর্বাধিক রপ্তানি হওয়া ১০টি দেশ হলো- নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান ও রাশিয়া। নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের শীর্ষ আমদানিকারক দেশ।
বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫৪২ মেট্রিক টন, জাপানে ১৩৬৬ মেট্রিক টন, অন্যান্য দেশে ৪২ হাজার ৯৬ মেট্রিক টনসহ মোট ৭৪ হাজার ৪২ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানি করা হয়েছে। এতে মোট আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। ভবিষ্যতে বৈদেশিক আয় আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ মাছ সরবরাহ
রপ্তানির ক্ষেত্রে নিরাপদ, মানসম্পন্ন মৎস্য এবং মৎস্যজাত পণ্যের উৎপাদন-মান নিশ্চিত করা মৎস্য অধিদপ্তরের অন্যতম লক্ষ্য, যা বাস্তবায়নে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে মৎস্য তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি পরিচালিত হচ্ছে। দেশে চিংড়ি উৎপাদনের সব স্তরে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন (গুড অ্যাকুয়াকালচার প্র্যাকটিস-জিএপি) এবং হাজার্ড অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল কন্ট্রোল পয়েন্ট (এইচএসিসিপি) ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০; মৎস্যখাদ্য বিধিমালা ২০১০ এবং মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন এবং বিপণন ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা, ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সহজ হচ্ছে নিরাপদ মাছ উৎপাদন। ‘মৎস্য ও মৎস্যপণ্য (পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ) আইন ২০২০’ শীর্ষক একটি নতুন আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এছাড়া নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে মাছের আহরণোত্তর সাপ্লাই চেইন স্থাপনা (আড়ত, ডিপো, বরফ কল), প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইত্যাদির লাইসেন্স প্রদান/নবায়ন। রপ্তানি হবে এমন পণ্যের কনসাইনমেন্টের নমুনা পরীক্ষণ করে মান নিশ্চিত করা হয় নিয়মিত। মাছের অবচয় হ্রাসরোধে আহরণোত্তর পরিচর্যা ও সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়াতে ‘পোস্ট হারভেস্ট লস রিডাকশন ইন দ্য ক্যাপচার ফিশারিজ সাপ্লাই চেইন’ শীর্ষক একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।
এছাড়া মৎস্য হ্যাচারি থেকে শুরু করে মাছচাষ ও প্রক্রিয়াকরণে জড়িত সব স্থাপনায় কার্যকরভাবে পরিদর্শনে ‘ফিশ অ্যান্ড ফিশারি প্রোডাক্টস অফিসিয়াল কন্ট্রোল প্রোটোকল’ ও ‘ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান-এনআরসিপি’ অনুসরণ করা হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের মৎস্য খাতে অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য উৎপাদনে আমাদের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানের পাশাপাশি সম্প্রতি চাষের মাছেও বাংলাদেশ বিশ্বে অর্জন করেছে তৃতীয় স্থান।
‘করোনা সংকটের মধ্যেও বিশ্বের যে তিনটি দেশ মৎস্য উৎপাদনে সাফল্য দেখিয়েছে তার অন্যতম বাংলাদেশ। দেশের মানুষের খাদ্য-পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশের মাছ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে দেশের রপ্তানি আয়ের ১ দশমিক ২৪ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে মাছ রপ্তানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৪ হাজার ৪২ দশমিক ৬৭ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৫ হাজার ১৯১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।’
মন্ত্রী বলেন, রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে মাছকে দেশের অন্যতম রপ্তানি খাতে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার নানান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। নিরাপদ ও মানসম্মত মৎস্য উৎপাদন এবং সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাজারে স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্যজাতপণ্য সরবরাহে মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় তিনটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মৎস্য মাননিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি স্থাপন ও পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রণয়ন করা হয়েছে মৎস্য ও মৎস্যজাতপণ্য মাননিয়ন্ত্রণ আইন ২০২০।
তিনি আরও বলেন, দেশে চিংড়ি উৎপাদনের সব স্তরে উত্তম মৎস্যচাষ অনুশীলন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিরাপদ ও মানসম্মত চিংড়ি উৎপাদন নিশ্চিতকরণে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা হয়েছে। মৎস্যচাষ পর্যায়ে ওষুধের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাকুয়াকালচার মেডিসিনাল প্রোডাক্টস নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা’ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকসহ ক্ষতিকর রাসায়নিকের রেসিডিউ দূষণ মনিটরিংয়ের জন্য ২০০৮ সাল থেকে প্রতি বছর ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী মাছ ও চিংড়ির নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
মাছ রপ্তানি বাড়ানোর মাধ্যমে মাছকে দেশের অন্যতম রপ্তানি খাতে রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানান শ ম রেজাউল করিম।