নিউজ ডেস্ক:
বিগত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দেন ভূমিপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মধুমতি-বাইগার নদীর পানিতে ভিজে, তাল-তমাল-হিজলের সবুজভরা হৃদয় নিয়ে, ক্রমেই বেড়ে ওঠেন। সেই ছোট্ট খোকা থেকে পরিণত হন জাতির পিতায়। এরপর বিশ্বনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়, তিনি স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান; তার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে সুদীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই মুজিব মানেই মুক্তি, মুজিব মানেই বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, দীর্ঘ দুই যুগের সংগ্রাম শেষে, ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এই পুরো সংগ্রামে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি যোগ করে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করায় মূখ্য ভুমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু। অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বলে অভিহিত করে। তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে ব্রিটেনের আরেক শীর্ষ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানে বলা হয় ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’।
শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই সমীহ করতেন শেখ মুজিবকে। আফ্রিকাসহ অনেক দেশের মুক্তি সংগ্রামেও মুজিব নামটি অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ভিয়েতনামের ঐতিহাসিক যুদ্ধেও যোদ্ধারা দীর্ঘ-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রাম সম্পর্কে জেনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিশ্বমঞ্চে যখন আবির্ভাব ঘটল বঙ্গবন্ধুর, তখন বিশ্বনেতারা তাকে একবার কাছে থেকে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। এরকমই একটি সময়ে, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।’ এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। সেই সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটিই হিমালয়। আমি এভাবেই হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছি।’
সদ্যস্বাধীন একটা দেশের প্রধান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধানরা তাকে মানবতা ও মুক্তির দূত হিসেবে গণ্য করতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে কুচক্রীরা। এই খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বসম্প্রদায়।
বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। মুজিবহীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেও পারছিল না কেউ, বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই তারা বাংলাদেশকে চিনেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’ দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট সংখ্যায় বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমিই রাষ্ট্র।’
বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজি এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।’
বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনেছে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে
আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক ও মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী নেতা মাহাথির মোহাম্মদ বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলও বাংলাদেশকে চিনতো বঙ্গবন্ধুর নামে। বাঙালির জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধুকে খুনের ঘটনায় বিশ্ববাসী এই জাতি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে।
২০০৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে এক সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘আফ্রিকার কোটি কোটি কৃষ্ণ মানবের মুক্তিদূত নেলসন ম্যান্ডেলার সমকক্ষ তোমাদের নেতা (বঙ্গবন্ধু)। তার অবর্তমানে বাংলাদেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে এবং এতিমের মতো অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। জন্মের পরপরই বাংলাদেশ অভিভাবকহীন ও নেতৃত্বহারা হয়ে পড়ায় এই দেশটির যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল, তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তোমাদের জাতির ভাগ্যে এতবড় ট্রাজেডি দেখে খুব আফসোস হয়।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকপটে মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, ‘তিনি তার দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অন্য দেশের কারাগারে থেকে, শুধু তার নামের জাদুমন্ত্রে পৃথিবীর ভৌগলিক রেখা পরিবর্তন করে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটান। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির নেই।
নেপোলিয়ন যা পারেনি, শেখ মুজিব তা করে দেখিয়েছেন
বিশ্বজুড়ে নন্দিত ফ্রান্সের নেতা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তাকে নেপোলিয়ন দ্য গ্রেট বলা হয়। সেই নেপোলিয়নের চাইতেও বঙ্গবন্ধুকে সফল বলে মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রানচিস মিতেরা।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশের সময় বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদকে তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের দেশের অদৃশ্য শক্তিধর এই লোকটির কী অজানা জাদু ছিল! দেখো, আমাদের ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট দি গ্রেট। তিনি ফ্রান্স থেকে বহু দূরে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে বন্দি হয়ে পড়েন, তোমাদের শেখ মুজিবের মতো বন্দি হওয়ার পর আমাদের জাতীয় বীর ফরাসি জাতির জন্য বা ফ্রান্সের জন্য আর কোনো অবদান রাখতে পারেননি। কিন্তু তোমাদের ভাগ্য-নির্মাতা (বঙ্গবন্ধু) তোমাদের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, অন্য দেশের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ডেথ সেলে বসেও, শুধু তার নামের অজ্ঞাত জ্যোতির্ময় আলোকচ্ছটা নিক্ষেপ করে, পৃথিবীর ভৌগোলিক রেখা পরিবর্তন করে, একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় ঘটান এবং একটি নতুন জাতির জন্ম দেন।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে এক বিস্ময়কর ঘটনা বলে অভিহিত করে ফ্রান্সের এই রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, ‘সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এবং বিশ্বের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে এমন দ্বিতীয় কোনো বিস্ময়কর ঘটনা কেউ কোনদিন, কোথাও প্রত্যক্ষ করেনি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো যোদ্ধা জাতিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অখ্যাত-অজ্ঞাত বীরযোদ্ধারা যখন পরাজিত করেছে বলে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে ভূমিকম্প তৈরি হয়। বিশ্বের নেতারা এবং সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা বিশ্বাস করতে পারছিল না! যার শিহরণ জাগানো জাদুবলে প্রায় শূন্য সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তোমরা (বাঙালি জাতি) ঐতিহাসিকভাবে বিজয়ী জাতির খেতাব পেলে, তার নামের গৌরব-গাঁথা বিশ্বের সব মানুষের হৃদয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে তোলো না কেন?’
এই ঘটনা যখন ঘটে, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক মুসা সাদিক। তিনি তার ‘বিশ্বনেতাদের চোখে বঙ্গবন্ধু’ বইতে এই তথ্য বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। আড়াই হাজার বছরে যা কেউ পারেনি, সেই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু যে ছক এঁকেছিলেন, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা মারফত আগাম তথ্য জানার কথা জানিয়েছেন কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বাবা তিনি। সেসময় বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান নেতা হিসেবে প্রভাববিস্তার করেছিলেন তিনি।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফরকালে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য দূরদর্শিতার কথা জানান পিয়েরে ট্রুডো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে ১৯৭০ এর দশকেই বাঙালি জাতিকে নিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হবেন, আশির দশক পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না, এমন গোয়েন্দা তথ্য উপ-রাষ্ট্রদূত অফিসের গোয়েন্দা মারফত আমরা পেয়েছিলাম। সেটার ব্যাখ্যা সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা তা সংগ্রহ করতে পারিনি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করা সেই ব্যাখ্যায় আমরা জানতে পারি যে, আশির দশকের পর রাশিয়ার রেড আর্মি থাকবে না বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। তখন পৃথিবীর ভারসাম্য একদিকে (যুক্তরাষ্ট্রের দিকে) হেলে পড়বে, আর তারা পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সমর্থক। সেই পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি ১৯৭০ সালেই যুদ্ধ শুরু পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সেই পূর্বাভাস ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় বিশ্বের বড় বড় নেতারা বিস্মিত হয়ে পড়েন। তাই তারা ১৯৭২ সালে তার কাছে তার দৈবদৃষ্টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন।’
‘যাদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছে, বঙ্গবন্ধু তাদের চেয়েও বড় নেতা’
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের চেয়েও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বড় নেতা বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। সশ্রদ্ধ চিত্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি বাংলাদেশি সাংবাদিক মুসা সাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তিনি পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চেয়েও অনেক বড় নেতা। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রথম সারির নেতা ছিলেন এবং যাদের নেতৃত্বে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তাদের সবার চেয়ে শেখ মুজিব অনেক বড় নেতা ছিলেন। ভারতের নেতাজি সুভাষ বসু, যিনি বাংলাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধ করে ভারতের আজাদি ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, একমাত্র তার সঙ্গে তোমাদের নেতার (বঙ্গবন্ধুর) তুলনা হতে পারে।’
১৯৯৬ সালের ২৫ মে, ভারতে বসে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। সেসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চান সাংবাদিক সাংবাদিক মুসা সাদিক। জবাবে বাজপেয়ী বলেন, ‘আমাদের নেতারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হতে দেয়নি। আমাদের নেতারা সমঝোতা করে, সব অধিকার ও দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে, ব্রিটিশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে, ভারতের স্বাধীনতা উপহার হিসেবে নিয়েছেন। কিন্তু তোমাদের বীর বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধ করে তোমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। আফ্রো-এশিয়ার দেশে দেশে, পাহাড়ে-জঙ্গলে মুক্তিযুদ্ধের জন্য যারা আজও লড়ছে, তারা তার (বঙ্গবন্ধুর) নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। তার নামের ধ্বনি দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা লাভ করছে। এই একটি ঐতিহাসিক কারণে তোমাদের জাতির পিতা পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষ সব নেতাকে অতিক্রম করে গেছেন।’
বিশ্বনেতাদের কাছে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন একজন জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব
১৯৭১ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন উইলি ব্রান্ডিট। ১৯৭৭ সালে পশ্চিম জার্মানিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাংলাদেশের ভূখণ্ড সম্পর্কে আগে তার ধারণা ছিল না। কিন্তু ডেথ সেলে বন্দি অবস্থায় শেখ মুজিব যে ম্যাজিক পাওয়ার প্রদর্শন করে একটা জাতিকে স্বাধীন করেছেন, সেটা বিশ্বনেতাদের কাছে অলৌকিক ঘটনার মতো ছিল। বিশ্বনেতারা তাকে এক পলক দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল।
এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে উইলি ব্রান্ডিট আরো বলেন, ‘এমন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন বিশ্বনেতাকে তোমরা হত্যা করলে কেন? যাকে ছাড়া বিশ্বনেতারা তোমাদের স্বীকৃতি দিতো না। তার হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববাসী তোমাদের জাতিকে আর বিশ্বাস করে না।’
বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব
আচমকা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। এই দুঃসংবাদ শোনার পর ব্রিটিশ এমপি জেমসলামন্ড বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশই শুধু এতিম হয়নি, বিশ্ববাসী হারিয়েছে একজন মহান সন্তানকে।’ ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী নেতা ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘আপসহীন সংগ্রামী নেতৃত্ব আর কুসুম কোমল হৃদয় ছিল মুজিব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।’
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেন সেদিন শোক দিবস পালন করেন। এমনকি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কে জি মোস্তফাকে সেদিনই ইরাক থেকে বের করে দেন। সাদ্দাম হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রথম শহীদ। তাই তিনি অমর।’
পরবর্তীতে কে জি মোস্তফা ঢাকা প্রেসক্লাবে সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে বলেছেন, ‘সকালে (১৫ অগাস্ট) সাদ্দাম হোসেন তার বিশেষ ফোর্স দিয়ে আমাকে প্রাসাদে তুলে নিয়ে যান, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য আমার কাছে কৈফিয়ত চান। ক্ষুব্ধ আচরণ করেন। বাকিতে দেওয়া ইরাকি তেলের সব টাকা সাত দিনের মধ্যে পরিশোধের হুকুম দেন। এরপর আমাকে তার দেশ থেকে বহিষ্কার করেন। সিরিয়াগামী একটি ফ্লাইটে জোর করে তুলে দেওয়া হয় আমাকে।’
কান পাতলে আজও শুনতে পাই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে নিজের মুগ্ধতার কথা অকপটে বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক পর, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি কমপ্লেক্সে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক মুসা সাদিককে কেনেডি বলেন, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু; খুব পপুলার স্লোগান। আমি যেন কান পাতলে আজও শুনতে পাই।‘
মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রণাঙ্গণ পরিদর্শনে এসেছিলেন ম্যাসাচুসেটস-এর এই সিনেটর। সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার সময় এই স্লোগান শোনেন তিনি।
পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তার ধানমন্ডির বাসায় এসেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারে কেনেডি বলেছেন, ‘তার (বঙ্গবন্ধুর) ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বশান্তি এবং তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী ও বর্ণবাদবিরোধী; যার সঙ্গে আমার আদর্শের মিল ছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তির অপচেষ্টা হয়েছে, সে ব্যাপারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিককে বলেন, ‘১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই বিশ্ববাসী তোমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার নামেই বাঙালিকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা দিয়েছে। আমি শুধু বলব, পৃথিবীতে দু-শ্রেণির প্রাণী আছে। মনুষ্য প্রাণী ও অমনুষ্য প্রাণী। তোমাদের বাঙালি জাতির ভাগ্য পাল্টাবে কে, যদি তোমাদের মনুষ্য জাতির মধ্যে অমনুষ্য প্রাণীর আধিপত্য প্রবল হয়ে ওঠে। যারা বিশ্বনন্দিত মহামানবসম শেখ মুজিবকে হত্যা করে অহংকার করতে পারে, তারা নরকের কীট।’