নিউজ ডেস্ক:
ফাইন্যান্স কোম্পানির ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি
ইচ্ছাকৃত খেলাপির কোনো ঋণ বা সুদ মওকুফ করা যাবে না, অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তা কিনতে পারবে না
ব্যাংক খাতের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির মতো ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো বা নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে। এখন থেকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত হওয়ার পর তিনি আর বিমান ভ্রমণ, ট্রেড লাইসেন্স, কোনো কোম্পানির নিবন্ধন, শেয়ার ছাড়ার অনুমোদন পাবেন না। একই সঙ্গে বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট কিনে নিবন্ধন করতে পারবেন না। অর্থাৎ কোনো সম্পদ বা কোম্পানি করে নতুন ব্যবসা করতে পারবেন না। ফলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিলাসী জীবনযাপনে বড় বাধা আসছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি অপরাধে মামলাও চলবে। এদিকে কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি বিধি ভঙ্গ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ছাড় দিলে তাদের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নীতিমালার আলোকে এখন থেকেই ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তার আলোকে এবার ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর জন্য এ নির্দেশনা জারি করা হলো। এর আগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে একই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
সার্কুলারে বলা হয়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের তথ্য অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণের কাজ ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। এ লক্ষ্যে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিটি ফাইন্যান্স কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে প্রধান নির্বাহীর দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তাদের দিয়ে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট গঠন করতে হবে। ওই ইউনিট প্রথমে ৩০ জুনের ঋণখেলাপিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা হিসাবে সার্কুলারে বলা হয়েছে, নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর ওপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করা না হলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
একই সঙ্গে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকলেও তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে উক্ত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ ব্যবহার করে খেলাপি হলে তিনিও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে গণ্য হবেন।
ঋণ বা অগ্রিমের বিপরীতে প্রদত্ত জামানত ঋণ বা অগ্রিম প্রদানকারী কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়া হস্তান্তর বা স্থানান্তর করে থাকলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপি হবেন।
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলও কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি পরিদর্শনে গিয়ে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করতে পারবেন।
সার্কুলারে বলা হয়, এখন থেকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হলে তিনি বা ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বিমান ভ্রমণ করতে পারবেন না। তারা নিজ নামে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবেন না। রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক অ্যান্ড কোম্পানিজ ফার্মস থেকে কোনো কোম্পানির নিবন্ধন পাবেন না। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকেও কোনো কোম্পানির শেয়ার ছাড়া বা বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পাবেন না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা চূড়ান্ত করার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওইসব তালিকা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোতে পাঠাবে। আইন অনুযায়ী ওইসব দপ্তর ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানে বিরত থাকবে।
এতে আরও বলা হয়, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি ইত্যাদি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অর্থাৎ প্রচলিত আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা গাড়ি, বাড়ি, জমি বা ফ্ল্যাটের নিবন্ধন করতে পারবে না। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না। কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপি তার সমুদয় ঋণ পরিশোধ করার পর ৫ বছর অতিক্রম না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে গণ্য হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত আইন মেনে তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে বা তাকে অপসারণ করতে পারবে।
সার্কুলারে আরও বলা হয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পর ওই তালিকার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আপিল করতে পারবে। আপিল না করলে বা তার করা আপিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গৃহীত না হলে সংশ্লিষ্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি গ্রাহকের কাছে সমুদয় পাওনা ফেরত চেয়ে ২ মাসের নোটিশ দিতে পারবে। নোটিশ প্রদানের দুই মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে ওই গ্রহীতার বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা করতে পারবে। এই মামলা করা হলেও ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার কার্যক্রম কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না, চলমান থাকবে।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকা প্রতি ত্রৈমাসিকে সংশ্লিষ্ট ফাইন্যান্স কোম্পানিকে তাদের অডিট কমিটির সভায় উপস্থাপন করতে হবে। কমিটি এতে মতামত বা সিদ্ধান্তসহ পর্ষদে উপস্থাপন করবে। ফাইন্যান্স কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কার্যক্রমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একটি টিকা আকারে তা বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ করার সুযোগ থাকলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কোনো ঋণ বা এর সুদ মওকুফ করা যাবে না। কোনো ইচ্ছাকৃত খেলাপির ঋণ হিসাব অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিনতে পারবে না। এই ঋণ সম্পূর্ণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি বা ওই প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন।
সার্কুলারে বলা হয়, কোনো ফাইন্যান্স কোম্পানি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সংক্রান্ত নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেছে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট ফাইন্যান্স কোম্পানিকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। যদি ওই লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রথম দিনের পর প্রত্যেক দিনের জন্য অতিরিক্ত কমপক্ষে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হবে।
এতে বলা হয়, ফাইন্যান্স কোম্পানি কর্তৃক ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত ও চূড়ান্তকরণের পর এ সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) পাঠাবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতাকে সিআইবিতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তথ্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে।
সার্কুলারে বলা হয়, আইন অনুযায়ী ফাইন্যান্স কোম্পানি তাদের কোনো খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা কি না তা শনাক্ত করবে। কোনো ঋণ গ্রহীতা খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার তৎপরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে উক্ত ঋণ গ্রহীতা ইচ্ছাকৃত খেলাপি কি না তা নিরূপণের লক্ষ্যে বিবেচ্য বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিয়ে ফাইন্যান্স কোম্পানির সংশ্লিষ্ট ইউনিট পর্যালোচনা করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্তকৃত হলে শনাক্তকরণের আগে গ্রাহকের বক্তব্য নিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে গ্রাহক বক্তব্য দিতে ব্যর্থ হলে বা গ্রাহকের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলে তিনি ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হবেন। তবে শিল্পনীতিতে সংজ্ঞানুযায়ী ‘বৃহৎ শিল্প’ খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, ‘মাঝারি শিল্প’ খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতি সম্পন্ন ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির বা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন দিতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে কোনো গ্রাহককে চিহ্নিত করা হলে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিতভাবে গ্রাহককে অবহিত করতে হবে।