নিজস্ব প্রতিবেদক:
সীমান্ত জেলা দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর সচল করতে জোর তৎপরতা চলছে। একইভাবে ভারতের সীমান্তের রাধিকাপুর অংশেও চলছে বিভিন্ন কার্যক্রম। বাংলাদেশ-ভারত সরকার সড়কপথে সরাসরি যাত্রীসহ পণ্য পরিবহনে একমত হওয়ার পর সংলগ্ন স্থলবন্দর দুটিকে কার্যকর করে তুলতে উভয় দেশই নিচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিরল স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিজিবি চেকপোস্টের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে চুক্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হলেই সড়ক ও রেলপথের একমাত্র এ স্থলবন্দর দিয়ে চার দেশে (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল) পণ্য আমদানি-রপ্তানির দ্বার উন্মুক্ত হবে। বাণিজ্যিক সেতুবন্ধ রচিত হবে চার দেশের মধ্যে। সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতির চাকা। কর্মসংস্থান হবে অনেকের।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর এবং ভারতের রাধিকাপুর এলসিএসের মাধ্যমে সড়কপথে বাণিজ্য চালুর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বন্দরটি সচল করতে বাংলাদেশ-ভারত একমত হয়েছে। তবে শুধু বন্দরটি চালু করলেই হবে না, দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট অনেকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলোতে দুই দেশের নীতিনির্ধারকদের একমত হতে হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে বন্দর চালুর ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরটি সচল হলে বাণিজ্যিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হবে। রাজস্ব আহরণের পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন হবে। এই পথকে ব্যবহার করে সরাসরি ভারত হয়ে অন্যান্য দেশেও সহজে যাতায়াত করতে পারবে সাধারণ মানুষ।
এদিকে, সম্প্রতি বিরল স্থলবন্দরের সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শনে যান রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন ও নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। পরিদর্শনকালে তারা দু’জনই স্থানীয় বাসিন্দাদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বন্দরটি চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তনয়ার এই অঙ্গীকার এবার বাস্তবায়ন হবে। এ জন্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সবই নিতে সম্মত উভয় মন্ত্রণালয়। তারা বলেন, বিরল স্থলবন্দর চালু হলে সংশ্নিষ্ট এলাকার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি চার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
গত বছর দুই দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিরল স্থলবন্দর চালু হলে রাষ্ট্র কী ধরনের সুবিধা পাবে, তা জানিয়ে লিখিত প্রস্তাব দেন। তিনি তার প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে সড়কপথে আরও বন্দর রয়েছে। তবে, বিরল স্থলবন্দর চালু হলে সড়কপথে সরাসরি পণ্য পরিবহনে শুধু ভারত নয়, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও সেতুবন্ধ রচিত হবে। এ বন্দর থেকে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। কিন্তু দু’পক্ষের (বাংলাদেশ-ভারত) মধ্যে চুক্তি হলে, একদিকে রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে দু’পক্ষের মানুষের চলাচলে গতিশীলতা আসবে এবং কূটনীতিক সম্পর্ক আরও গভীর হবে।
ডিসির এই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিরল স্থলবন্দর এবং ভারতের রাধিকাপুর এলসিএসের মাধ্যমে সড়কপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে রুট ঘোষণার জন্য প্রথমে গত বছরের ২৪ জুন, পরে চলতি বছরের ২৯ মার্চ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে নৌ-মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যেন বন্দরটি চালু করতে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়। এসব চিঠি ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৮-২০ জুলাইয়ে ‘গ্রুপ অন ইনফ্রাস্ট্রাকচার অব এলসিএস-আইসিএস’-এর সভায় এই রুট চালুর বিষয়ে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছায়। বিষয়টি নৌ-মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষও জানতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে এমনকি তার পরও দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে ভারতের রাধিকাপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে পণ্য এবং যাত্রী পরিবহন করা হতো। ২০০৫ সালে ভারতীয় এলাকায় রেলপথ ব্রডগেজে রূপান্তরিত হলে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। এরপর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক নানা ইস্যুতে সমঝোতা না হওয়ায় এই রেলপথ আর চালু হয়নি। এই রেলপথে চার দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্র্রসারণে ২০০৬ সালে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় ২৫ বছরের জন্য বিরল স্থলবন্দর লিমিটেডের নামে একটি বেসরকারি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সড়ক নির্মাণে ৭১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়। ২০১৭ সালে পণ্য পরিবহন ও যাত্রীবহন সহজ করতে রেলপথসহ বিভিন্ন রেলওয়ে স্টেশন আধুনিকায়ন করা হয়।