নিউজ ডেস্ক:
করোনা মহামারীর মধ্যে প্রণোদনার ঋণ ছাড়া ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ বিতরণে তেমন অগ্রগতি নেই। এ কারণে প্রতি মাসেই বেসরকারী খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ফলে ব্যাংকগুলো আমানত হিসেবে যা নিয়ে রেখেছে, তা অলস পড়ে আছে। আর এর সঙ্গে প্রতি মাসেই রেমিটেন্সের অর্থ যুক্ত হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমে গেছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে প্রায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা আছে। আর একেবারেই অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো। একই সঙ্গে বাজারে বেশি টাকা চলে যাওয়ায় তা মূল্যস্ফীতি বাড়ার ঝুঁকিও তৈরি করে। এই অবস্থায় ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অলস টাকা তুলে নিতে বিভিন্ন ‘বন্ড’ ও ‘বিল’ নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে দুই দফায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’-এর নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর বাইরে ৫ বছর ও ৩০ দিন মেয়াদী বন্ডেরও নিলাম করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি নিলামে অংশ নিতে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বাড়তে থাকায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার মতো অলস টাকা বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অলস টাকা তুলে নিলে ব্যাংকগুলো আমানতে আগ্রহ দেখাবে। ফলে আমানতকারীরা লাভবান হবেন।’
জানা গেছে, বাজার থেকে টাকা তুলতে বেশ কয়েকটি মাধ্যম ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো হলো-রিভার্স রেপো, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ ও নগদ জমার হার (সিআরআর)। এর মধ্যে প্রথম দুটির মাধ্যমেই ব্যাংকগুলোর সুদ আয় বেশি হয়ে থাকে। বর্তমানে রিভার্স রেপোর সুদহার ৪ শতাংশ। আর ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের’ সুদহার বাজার চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। তবে তা কলমানির সুদহারের চেয়ে কিছুটা কম হয়। বর্তমানে ৭, ১৪ ও ৩০ দিন মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ চালু রয়েছে। এর মানে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের’ মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের জন্য ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে টাকা জমা রাখতে পারবে। বর্তমানে প্রণোদনার ঋণ ছাড়া নতুন ঋণ চাহিদা নেই বললেই চলে। মহামারীর মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বেড়েছে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ সব কারণেই ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত টাকা জমা হয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে, জুন শেষে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা একেবারেই অলস; অর্থাৎ এই টাকা থেকে কোন ধরনের সুদ বা মুনাফা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বাকি টাকায় কেনা হয়েছে বিভিন্ন বিল ও বন্ড। অনেক ব্যাংক অলস টাকার অপব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ আছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ ছেড়ে অলস টাকা তুলে নেয়ার পাশাপাশি আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, তারা অতিরিক্ত টাকা তুলে নিলে ব্যাংকগুলো আবার আমানত সংগ্রহ আগ্রহী হবে। ইতোমধ্যে কয়েক দফায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ নিলাম করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মাসেই আরও চারটি নিলাম হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদী বিলের ওপর দুটি নিলাম হবে আগামী ২৫ আগস্ট। অন্যদিকে ৩০ দিন মেয়াদী বিলের পরের দুটি নিলাম হবে ২৩ ও ৩১ আগস্ট। জানা গেছে, গত ১১ আগস্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৩০ দিন মেয়াদে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে’ যে বিনিয়োগ করেছে, তাতে সুদহার দশমিক ৫৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ব্যাংকগুলো মুনাফা করবে ২ কোটি ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এর আগে ৯ আগস্ট নিয়ে ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদী বিলের নিলাম হয়। সাত দিন মেয়াদী বিলে ব্যাংকগুলো বার্ষিক শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ সুদে বিনিয়োগ করে ১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো এই বিলের বিপরীতে সুদ হিসেবে আয় করে ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। ১৪ দিন মেয়াদী বিলে বিনিয়োগ করা হয় এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই বিলের সুদহার নির্ধারণ করা হয় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই বিলের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সুদ হিসেবে আয় করবে ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৬ টাকা। সব মিলিয়ে প্রথম দিনের নিলামে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে ২ হাজার ৬০৫ কোটি। বিপরীতে ব্যাংকগুলো ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬০ টাকা মুনাফা করেছে। সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো ৭ ও ১৪ দিন মেয়াদী ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিল’ নিলামে অংশ নেয় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকগুলো সাত দিন মেয়াদী বিলে বিনিয়োগ করে ২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। ১৪ দিন মেয়াদী বিলে বিনিয়োগ করে ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে আন্তঃব্যাংক কলমানিতে সর্বনিম্ন সুদ ১ শতাংশ এবং আন্তঃব্যাংক রেপোতে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বার্ষিক সুদহার নির্ধারিত আছে। সর্বনিম্ন এই সুদে টাকা খাটানোর পরও অধিকাংশ ব্যাংকের কাছে অলস টাকা থাকছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো আর এই টাকা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করবে না। ফলে যেটুকু সুদ পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই ব্যাংকগুলো খুশি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন একটি ব্যাংক মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ তথা ২ পয়সা সুদে সাত দিনের জন্য ১৫০ কোটি টাকা রেখেছিল। এরপর থেকে নিলাম বন্ধ ছিল। বাজারে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীকে চিঠি দিয়ে নিলামের বিষয়টি অবহিত করা হয়। এর আগে ২৯ জুলাই চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, অতিরিক্ত তারল্য আর্থিক খাতে বুদ্বুুদ তৈরি করলে তা তুলে নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। অতিরিক্ত তারল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি বা সম্পদের দাম বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন নীতি গ্রহণে দ্বিধা করবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাংকগুলোর হাতে প্রচুর অতিরিক্ত তারল্য আছে। ফলে আমানতের সুদহার তলানিতে নেমেছে। এতে আমানতকারীরাও অস্বস্তির মধ্যে আছে। তাই সব কিছু চিন্তা করে বাজার থেকে অতিরিক্ত তারল্য তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ব্যাংকের হাতে অলস তারল্যের বিপরীতে ব্যাংকের কোন আয় নেই। এ অবস্থায় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিলে’ বিনিয়োগ করে যে অর্থই পাওয়া যাবে, সেটি ব্যাংকের জন্য মঙ্গল। আর অলস টাকা তুলে নিলে ব্যাংকগুলো আমানতে আগ্রহ দেখাবে। ফলে আমানতকারীরা লাভবান হবেন।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘১ শতাংশের নিচে সুদহার কম নয়। ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত টাকা অলস পড়ে ছিল। কোন লাভ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যম ব্যাংকগুলো অন্তত কিছু টাকা বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে।’
আরও ৫৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ ॥ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছর বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহ সাড়ে ১৪ শতাংশ ধরে মুদ্রানীতি ঘোষণা হলেও অর্জিত হয়েছে ৮ শতাংশের মতো। সাধারণভাবে নগদ জমার হার (সিআরআর) সংরক্ষণের পর ব্যাংকগুলোর ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা অলস থাকে। তবে করোনা শুরুর পর ২০২০ সালের জুন শেষে তা ২৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা হয়। সম্প্রতি ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সিআরআরের অতিরিক্ত রিজার্ভ গত এক বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। করোনার মধ্যে প্রবাসী আয় অনেকটা বেড়েছে। এই অর্থের একটি বড় অংশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। আবার প্রণোদনার এক লাখ কোটি টাকারও বেশি ঋণের একটি অংশ ঘুরে ফিরে আবার ব্যাংকেই এসেছে। জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে একেবারে অলস পড়ে আছে ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অলস এ অর্থের বিপরীতে কোন সুদ পায় না ব্যাংক। এতে করে অধিকাংশ ব্যাংক এখন আমানত নিতে অনীহা দেখাচ্ছে। তবে সম্প্রতি নিলামে অংশ নিতে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বাড়তে থাকায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার মতো অলস টাকা বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ আরও আসছে ॥ পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ গবর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ড বিক্রয়ের (রি-ইস্যু) নিলাম হয় ১০ আগস্ট। এটির সঙ্গে অবশ্য এই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের কোন সম্পর্ক নেই। তবে এই নিলামও ব্যাংকগুলোর অলস টাকা বিনিয়োগের একটি সুযোগ তৈরি করবে। গত সপ্তাহে পাঁচ বছরের বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ড বিক্রির (পুনরায় ইস্যু) নিলামের মাধ্যমেও এক হাজার কোটি টাকা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫ বছরের ট্রেজারি বিলের সুদ হার ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। নিলামে গত ১৮ মার্চ ইস্যুকৃত পাঁচ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ড ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ২০২৬ সালের ১৮ মার্চ, এক কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের বন্ড রি-ইস্যু করা হয়। এখানে ব্যাংকগুলো মোট ২ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা ইস্যু করে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে ১০ বছর-মেয়াদী বাংলাদেশ গবর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ড বিক্রয়ের (রি-ইস্যু) নিলাম অনুষ্ঠিত হবে আজ মঙ্গলবার। নিলামে চলতি বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত ১০ বছর-মেয়াদী ট্রেজারি বন্ড (কুপন হার ৬.০১ শতাংশ), এবং মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০৩১ এর এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা অভিহিত মূল্যের বন্ড রি-ইস্যু করা হবে। রি-ইস্যু নিলাম প্রাইসভিত্তিক হবে। নিলামে রি-ইস্যুকৃত ট্রেজারি বন্ড ডিসকাউন্টে, প্রিমিয়ামে বা অভিহিত মূল্যে বিক্রয় হতে পারে। বিজয়ী বিডাররা স্ব স্ব বিডমূল্য পরিশোধ করবে। রি-ইস্যুকৃত বন্ডের জন্য বার্ষিক ৬.০১ শতাংশ হারে কুপন বা মুনাফা ষান্মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ্য হবে। নিলামে কেবল সরকারী সিকিউরিটিজের প্রাইমারি ডিলারের ভূমিকায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিড দাখিল করতে পারবে। তবে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও (নিজস্ব খাতে বা তাদের ব্যক্তি/প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গ্রাহকদের জন্য) প্রাইমারি ডিলারের মাধ্যমে অকশনে বিড দাখিল করতে পারবে। অভিহিত মূল্যে প্রতি ১০০ টাকা মূল্যের বন্ড ক্রয়ের জন্য কাক্সিক্ষত প্রাইস ও বন্ড ক্রয়ের পরিমাণ উল্লেখ করে নিলামের দিন সকাল ১০টা হতে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে স্থাপিত এমআই মডিউলের মাধ্যমে বিড দাখিল করতে হবে। তবে বিশেষ কোন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে পূর্বে অনুসৃত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিড দাখিল করা যেতে পারে। নিলামে অংশগ্রহণের পদ্ধতিগত নির্দেশনা ইতোমধ্যে প্রাইমারি ডিলারসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে।