সুরজিত সরকার:
আমাদের সমাজের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানা রকম ঘটনা বা অনুঘটনা। সেগুলোর কতটুকু খবর আসে আমাদের কাছে। এমনিতেই বিষময় দুই হাজার কুড়ি। মানুষের জীবন যাত্রায় রেখা নিচের দিকে নামছে সেখানে সমাজের নিচু শ্রেনীর মানুষগুলোর জীবন কেমন করে চলছে। কে কার খবর রাখে এই সময়ে। নাহ। এরও ব্যতিক্রম রয়েছে। যেখানে মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রয়োজন হয় শুধু একটি শব্দের সেটি হলো মানুষ। রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে কিছু করা যায় সেটিই করে দেখালেন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার পিপরুল ইউনিয়নের শ্যামনগর গ্রামের মো: বিনছের আলী। সেখবরে বিচলিত হয়ে নলডাঙ্গার ইউএনও দায়িত্ব নিলেন গর্ভবতী মায়ের নিরাপদ স্বাস্থ্যের।
চলতি মাসের ১৬ তারিখ সকালে হঠাৎ করেই বারনই নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। এতে তলিয়ে যায় বাঁশিলা দক্ষিণ পাড়া গ্রাম। বন্যার পানিতে ডুবে যায় শরিফুল ইসলাম পারভেজের বাড়ি। তারা ঘর বাড়ি ছেড়ে নদীর পাড় হয়ে আশ্রয় নেয় শ্যামনগর গ্রামের মো: বিনছের আলীর বাড়িতে। পারভেজের মেয়ে সুরাইয়া গর্ভবতী। সবকিছু মিলে পাহাড়সম কষ্টের মধ্যে পড়ে গিয়েছে পরিবারটি।
নয় সদস্যের বিনছেরের পরিবার চলে টানাটানিতে। তারপরও আরও পাঁচ জনকে আশ্রয় দিয়েছেন। পেশায় একজন সাইকেল মেকানিক বিনছের। তারপরও মহানুভবতার এক বিশাল উদাহরণ হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন বিনছের। মানুষ মানুষের জন্য কথাটি আবারও প্রমাণিত হলো।
গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে খবর পেয়েই ঘটনা স্থলে ডাক্তার ও স্বাস্থথ্যকর্মী নিয়ে ছুটে যান নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন। ইউএনও মামুন সকলের খোঁজ খবর নেন ও গর্ভবতী মাকে পুষ্টিকর খাদ্য সামগ্রী দেন। এসময় গনমাধ্যম কর্মীদের ধন্যবাদ দিয়ে নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আপনাদের মাধ্যমে আমি প্রথম বন্যায় আক্রান্তদের খবর পায়। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বন্যায় ঘর বাড়ি ডুবে যাওয়া একটি পরিবারে একজন গর্ভবতী মা আছেন। যারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এ খবর পেয়ে আমি ছুটে এসেছি। আমার কাছে সরকারী দায়িত্বের চেয়ে মানবিকতার বিষয়টি সবথেকে বড় মনে হয়েছে। এখানে এসে সেটিই দেখলাম। যারা আশ্রয় দিয়েছেন তাদেরও আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। ডাক্তার সাহেব কে অনুরোধ করেছি আসার জন্য। সবকিছু শুনে তিনিও ছুটে এসেছেন।
এব্যাপারে মা, শিশু ও পরিবার কল্যাণ নাটোর সদরের ডাক্তার ইয়াদুল ইসলাম এম.ও বলেন, গর্ভবতী মায়ের বর্তমান অবস্থা ভালো রয়েছে। ডেলিভারীর সময়ের আরও আনুমানকি একমাস দেরি আছে। এসময়টা আমাদের মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবেন এবং শারিরিক পরীক্ষা নীরিক্ষা করবেন। সেভাবেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং আপাতত প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ দেয়া হয়েছে।
একরকম দূরদর্শিতা বলা যায় বিনছের আলীর। তারপরও যে মানবিকতা দেখিয়েছেন তার মুখে কথা গুলো শোনার সময় দেখা যাচ্ছিল উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চোখ। মো: বিনছের আলী বলেন, শ্যামনগর বাজারে সাইকেল ভ্যান মেরামতের একটি দোকান আছে। সুরাইয়াদের সাথে পরিচয় অনেক দিনের। ওদের ঘর বাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে গেলে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে আসি ওদের অসহায় অবস্থা দেখে। বিপদে মানুষের পাশে মানুষ না দাঁড়ালে কি করে হবে। সবাই এখন এক সাথেই আছি আমরা।
আমাদের দেশে একজন গর্ভবতী মায়ের জন্য গর্ভকালীন সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিষয়টি অনেকেই এখনও অনুধাবন করে না।
সুরাইয়ার মা জুনুপা বলেন, আমরা খুব অসহায়। আমার স্বামী একরকম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কখনও ভিক্ষা করে আবার কখনও ঘুরে বেড়াই। আমার তিন মেয়েকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি। এরমধ্যে বন্যাতে আমাদের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। ইউএনও স্যার খবর পেয়ে আমাদের সাহায্য করতে এসেছে। আরও সাহায্য করবে বলেছে। আমার গর্ভবতী মেয়েটাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিছে। আল্লাহ স্যারের ভালো করবেন।
আনন্দে আপ্লুত হয়ে সুরাইয়া আক্তার বলেন, বিপদের মধ্যে সরকারের সাহায্য পেয়ে মনে হচ্ছে আল্লাহ আমাদের জন্য ভালো করতে স্যারকে পাঠাল। আমার স্বামী একজন শ্রমিক সে কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে যায়। এখন কাজ করতে দিনাজপুর গেছে। এর মধ্যে এই বিপদ।
এছাড়াও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মাধনগর ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আবদুল মালেক ব্যাপারী, মাধনগর ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক মো: আনোয়ারুল হক ও মাধনগর ইউনিয়নের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মোছা: নাজমা বানু।
কিছু ভালো মানুষ না থাকলে যে পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবেনা। প্রকৃতি সবসময় সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলে আর এজন্যই মো: বিনছের আলীরা বারবার ফিরে আসেন সমাজে আর তাদের পাশে পেছনের কারিগর হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ইউএনও মামুনেরা।