নিউজ ডেস্ক:
বিদ্যুত ও জ্বালানির অপচয় রোধে এবার সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের পর এবার বাণিজ্যিক ও ব্যক্তি খাতে অপচয় বন্ধে নেয়া হচ্ছে নতুন উদ্যোগ। এ লক্ষ্যে এখন থেকে বিদ্যুত সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার, উৎপাদন কিংবা আমদানিতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘যন্ত্রপাতির জ্বালানি দক্ষতার লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০২২’ শিরোনামের এই প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করেছে সরকার।
জানা গেছে, দেশে যেসব বৈদ্যুতিক উপকরণ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগ নিম্নমানের। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিদ্যুতের অপচয় বেশি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশে বর্তমানে ব্যবহৃত মোট জ্বালানির ৪৮ ভাগ শিল্প এবং ৩০ ভাগ আবাসিক খাতে ব্যবহৃত হয়। প্রযুক্তির পরিবর্তন ও দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে শিল্পে ৩১ ও আবাসিকে প্রায় ৩৬ ভাগ জ্বালানি সাশ্রয় সম্ভব। এ কারণে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণ উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। দেশে এখন জ্বালানির সঙ্কট রয়েছে। এ কারণে লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে দেশে বিদ্যুত ও জ্বালানি সাশ্রয় করতে হলে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ উৎপাদনে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
এখন সেটি বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে দেশে বিদ্যুত ও জ্বালানি সাশ্রয় করতে হবে। এ খাতের অপচয়রোধ করা এখন সময়ের দাবি। এদিকে আন্তঃ মন্ত্রণালয় সভার কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তুতকৃত খসড়ার ওপর স্রেডা অংশীজনদের নিয়ে ৪টি কর্মশালা আয়োজন করে। কর্মশালায় উপস্থিত সদস্যদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করে স্রেডা খসড়া প্রবিধানমালাটি পরিমার্জন করে গতবছর বিদ্যুত বিভাগে প্রেরণ করে। বিদ্যুত বিভাগ গঠিত একটি কমিটি প্রবিধানমালাটি পর্যালোচনা করে প্রবিধানমালাটির শিরোনাম পরিবর্তন ও প্রবিধানমালায় বিএসটিআই-এর কাজের সঙ্গে যেসব প্রবিধিতে দ্বৈততা আছে সেগুলো সংশোধনের নির্দেশনা প্রদান করেছিল। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্রেডা প্রবিধানমালাটির সংশোধিত খসড়া বিদ্যুত বিভাগে প্রেরণ করেছে।
ওই খসড়ার ওপর বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, আমদানি-রফতানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দফতর, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক), বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ এ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড (বিএবি) এর মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাপ্ত সকল মতামতের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্ত খসড়া প্রেরণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-এর পরিচালক (মান) প্রকৌশলী নিলুফা হক বলেন, যে লেবেলে ডিজাইন, লেবেলের ধাপ নির্ধারণ, কোম্পানি নিবন্ধন, মডেল নিবন্ধন ও প্রয়োজনীয় ফি গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রম বিএসটিআই বাস্তবায়ন করবে। স্রেডা শুধু জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এ প্রেক্ষিতে ফারজানা মমতাজ (সদস্য জ্বালানি দক্ষতা) আরও বলেন, ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন-২০১৮ এবং পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা-২০২১ এ পণ্যের মোড়কজাতকরণ পদ্ধতি ও মোড়কে পরিমাপ সংক্রান্ত ঘোষণার সাধারণ বিধান ও লেবেলিং পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে।
সুতরাং দেশে লেবেলিং কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিএসটিআই এবং স্রেডার সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে যুগ্মসচিব নিরোধ চন্দ্র ম-ল (নবায়নযোগ্য জ্বালানি)- বলেন, সভার মাধ্যমে চূড়ান্ত খসড়া প্রবিধানমালাটি লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে প্রেরণ করা হবে। তারা বিএসটিআই বা অন্য কোন সংস্থার আইনের সঙ্গে দ্বৈততা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা তা যাচাই করবে। বিদ্যুত বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোঃ গোলাম ফারুক বলেন, বিদ্যুত বিভাগ যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদির সংজ্ঞা হালনাগাদ যন্ত্রপাতির নিরিখে প্রদান করা উচিত।
ওই বৈঠকে মহাপরিচালক পাওয়ার সেল মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, কারিগরি কমিটিতে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে তিনজন প্রতিনিধির কথা উল্লেখ করা আছে তা সুস্পষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, আইনগত কাঠামোর মধ্যে লেবেলিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
যেভাবে বিদ্যুত সাশ্রয় করা যাবে ॥ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে বিদ্যুত সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করছে বাংলাদেশ। চলমান বিদ্যুত সঙ্কট মোকাবেলায় রাত ৮টার পর বন্ধ রাখা হচ্ছে দোকানপাট, শপিংমল। সপ্তাহে একদিন পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার মতো কর্মসূচী অব্যাহত রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু সরকার নয়, সঙ্কট মোকাবেলায় বাণিজ্য খাতসহ দেশের জনগণকে সচেতন হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন ধরনের সাশ্রয়ী নীতিকৌশল অবলম্বন করে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে বিদ্যুতের সঙ্কট দূর হবে। এজন্য বিদ্যুত সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও উপকরণে গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক উপকরণ ব্যবহারের ওপর সরকার গুরুত্বারোপ করছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি জানান, এ লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ‘স্রেডা’ ও জাপানী মিৎসুুবিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মধ্যে জ্বালানি সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এখন সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
তিনি জানান, দেশের স্বার্থে বিদ্যুত ও জ্বালানির অপচয় বন্ধ করতেই হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এছাড়া দৈনন্দিন জীবনে টিউব লাইটে ভাল মানের ইলেক্ট্রনিক্স ব্যালেস্ট ব্যবহার করলে বিদ্যুত বিল কম আসবে। ফ্যানের ইলেক্ট্রনিক্স রেগুলেটর হলে বিদ্যুত বিলের খরচ বেঁচে যাবে। বিভিন্ন পয়েন্টে অযথা চার্জার লাগিয়ে রাখলেও কিছু বিদ্যুত খরচ হয়। বিনা প্রয়োজনে ওভেন, ফ্যান, পিসি ইত্যাদি বন্ধ করে রাখা উত্তম। এনার্জি সেভার বাল্ব ব্যবহার শুরু করতে হবে। রেফ্রিজারেটরের কয়েল পরিষ্কার রাখা এবং এসি ব্যবহারে মিত্যব্যয়ী হওয়া জরুরী।
এছাড়া বাজারে গত কয়েক বছরে ‘সাশ্রয়ী’ বৈদ্যুতিক বাতিতে (এনার্জি ইফিশিয়েন্ট বাল্ব) সয়লাব হয়ে গেছে। অনুমোদন নিয়ে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান দেশে উৎপাদন ও বিপণন করছে। কিন্তু নামে-বেনামে অর্ধশতাধিক কোম্পানির নিম্নমানের বাল্ব বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব মানহীন বাল্ব বিক্রি আইনসম্মত নয়। এছাড়া নিয়ন্ত্রণহীণ বৈদ্যুতিক বাতির বাজার। ফ্যান, মোবাইল চার্জার, চার্জার লাইট, সুইচ, ফ্যানের ক্যাপাসিটর, গিজার ও আয়রনসহ অন্য যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন করা হচ্ছে তা বেশির ভাগই নিম্নমানের। এমনকি আমদানিকৃত বৈদ্যুতিক পণ্যের মানও সন্তোষজনক নয়। নানা ধরনের ছলছাতুরির আশ্রয় নিয়ে আমদানি হচ্ছে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পণ্যসামগ্রী।
তবে নিম্নমাণের পণ্য বিপণন বন্ধে উদ্যোগের কমতি নেই বলে দাবি করেছে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ। তাদের মতে, নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, মাল জব্দ ও জরিমানার পরও তেমন সুফল আসছে না। এ পর্যায়ে উৎপাদন ও আমদানি করা পার্টস সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানেও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বৈদ্যুতিক বাতির বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ভ্রাম্যমাণভাবেও বাল্ব বিক্রি হচ্ছে। ফলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শতভাগ সমাধান সম্ভব নয়। এছাড়া ক্রেতাদের কাছে পণ্যের মান ও ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা জরুরী।