নিউজ ডেস্ক:
সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও তেলের বিকল্প উৎস খুঁজতে মরিয়া সরকার। এর মধ্যেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), ডিজেল আমদানিতে বিকল্প বাজারের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে বিদ্যুৎও। তবে দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও উৎপাদন বাড়াতে শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। যেসব অলস বা মেয়াদোত্তীর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলোকে নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। এরই মধ্যে নরসিংদীর ঘোড়াশালকে নিয়ে করা হচ্ছে নতুন পরিকল্পনা।
ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে দেশের প্রথম এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৩ ও ৪ নম্বর ইউনিটের সংস্কারের কাজ। অবসরে যাওয়া ১ এবং ২ নম্বর ইউনিটকেও কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই কেন্দ্র হতে দৈনিক অন্তত ১ হাজার ৩৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে করে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যুতের বড় একটা চাহিদা মিটবে বলেও দাবি তাদের।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ঘোড়াশালে ১৯৮৬ সালে স্থাপন করা হয় স্টিম টারবাইনের তৃতীয় বিদ্যুৎ ইউনিট। সে সময় এর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১০ মেগাওয়াট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১৭০ মেগাওয়াটে। পরে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টে রূপান্তর করতে ‘ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট রিপাওয়ারিং’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।
মূল প্রকল্পটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য থাকলেও তা পিছিয়ে যায়। এটি বাস্তবায়নে বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে চীনের এইচএসবিসি ব্যাংক অর্থায়নের সহায়তা করে। পরে নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন ২ বছর বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে এই প্রকল্পের কাজ। একইভাবে শেষ হয়েছে এর ৪র্থ ইউনিটের রিপাওয়ারিংয়ের কাজও। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৪০৯ মেগাওয়াট।
এর মধ্যে গ্যাস টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদিত হচ্ছে ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং স্টিম টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদনের বিষয়টি চলমান রয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট ৫ এর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২১০ মেগাওয়াট। এখান থেকে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে ১৯০ মেগাওয়াট। ইউনিট ৩ এর উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ৪১৬ মেগাওয়াট। এটিতে স্টিম টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদিত হচ্ছে ১৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ ছাড়াও ইউনিট ৭ এর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ৩৬৫ মেগাওয়াট।
এটিতে গ্যাস টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদন হচ্ছে ২৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং স্টিম টারবাইন থেকে উৎপাদন হচ্ছে ১১৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে একটি অগ্নিকা-ের ঘটনায় এর ৬ নম্বর ইউনিট থেকে ২১০ মেগাওয়াট উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। প্রত্যেকটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানোসহ এর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে মেয়াদ শেষ হয়ে অবসরে যাওয়া এই কেন্দ্রের ১ এবং দুই নম্বর ইউনিটকে একত্রে ২৩০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, বৈশ্বিক চলমান সংকট শুরুর আগেই ২০২০ সালে সরকারি পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্যতা জরিপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ওই সময় অভিযোগ ওঠে, সরকার বিনা প্রয়োজনেই পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখছে। ফলে একদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জ্বালানি খরচ বেশি হচ্ছে যেমন তেমনি অন্যদিকে এসব কেন্দ্র বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করায় ব্যয়ও বাড়ছে।
কিন্তু তখনো ঘোড়াশালের দুটি ইউনিট এবং সিলেটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রি-পাওয়ারিংয়ের কাজ চলমান ছিল। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সিম্পল সাইকেল থেকে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরের কাজ মূলত তখনই পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। এতে একই পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করে দ্বিগুণ বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়।
এসবের প্রেক্ষাপটে ঘোড়াশাল পাওয়ার স্টেশন হবে বিদ্যুতায়নের আধুনিক হাব এমন মন্তব্য করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এ হাব নরসিংদী-টঙ্গীসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সহযোগিতা করবে। শুধু তা-ই নয় এর সাবস্টেশন ও জিআইএস সুইচিং স্টেশন বিদ্যুতের মান সমন্বিত রেখে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে দেবে।
তিনি বলেন, এটি দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম বিদ্যুতায়নের প্রথম দিককার হাব। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে এর প্রথম ইউনিট কমিশনিং হয়েছিল। দ্বিতীয় ইউনিট ১৯৭৬ সালে কমিশনিং হলেও বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টাতেই সব কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এ পাওয়ার হাবের আধুনিকায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এখান থেকে দৈনিক অন্তত ১৩শ ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি।