নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান এবং নারী-শিশু পাচার বন্ধে বিজিবিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তুলবে।
গতকাল সকালে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৯৫তম ব্যাচ রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড কলেজ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রামের মূল অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন। বাসস।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তৃতা করেন। বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম বিজিবি ট্রেনিং সেন্টার থেকে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীকে অনুষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয়। তিনি নবীন সদস্যদের মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজও উপভোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা আধুনিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলেছি। কাজেই, আমাদের বর্ডার গার্ড সেভাবে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, তারা আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সুরক্ষার পাশাপাশি চোরাচালানি, নারী ও শিশু পাচারসহ সীমান্তে যেসব অপকর্ম হয় সেগুলো বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে আমরা বিশেষভাবে নজর দিয়েছি। তিনি বলেন, সব সময় মনে রাখতে হবে যে কোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীর জন্য সব থেকে বেশি শৃঙ্খলার প্রয়োজন। কাজেই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে সবাইকে চলতে হবে। বাংলাদেশ যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন হয়েছে, সে আদর্শ নিয়েই চলতে হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ মেনে কর্তব্য পালনে নির্ভীক থাকতে হবে। আর অধস্তনদের প্রতিও সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর এই বাহিনীর তৃতীয় রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ উদ্ধৃত করেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আজ আপনাদের কাছে আমি অনেক বড় কর্তব্য দিয়েছি, অনেক বড় কাজ দিয়েছি। এ কাজ হলো চোরাচালানি বন্ধ করা। তোমাদের কাছে আমার হুকুম, স্মাগলিং বন্ধ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা পারবা। এ বিশ্বাস তোমাদের ওপর আমার আছে। আশা করি, তোমরা স্মরণ রাখবা। মনে রাখতে হবে, স্মাগলারের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই, তারা মানুষ নামের নরপশু। তারা এদেশের সম্পদকে বিদেশে চালান দেয় সামান্য অর্থের লোভে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বক্তব্যে জাতির পিতার যে নির্দেশনা রয়েছে, আমি আশা করি, আপনারা তা মেনে চলবেন। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি এই অপকর্মগুলো রোধ করতে আপনারা আন্তরিকভাবে কাজ করবেন। কারণ, এই কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক।
শেখ হাসিনা বলেন, দেশ ও জাতির প্রতি সেবার মনোভাব নিয়ে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হবে এবং মনে রাখতে হবে এই দেশ অর্থনৈতিকভাবে যত উন্নত হবে আপনাদের পরিবারগুলোও উন্নত হবে।
শেখ হাসিনা করোনা প্রসঙ্গে বলেন, দারিদ্র্যের হার আমরা ৪০ ভাগ থেকে ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছিলাম এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম আরও দুই/তিন ভাগ কমিয়ে আনার। কিন্তু করোনার কারণে তা কিছুটা হয়তো থেমে গেছে। যদিও আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সবাইকেই এভাবে সহযোগিতা করছি, যাতে সবাই নিজ নিজ অবস্থানে সুরক্ষিত থাকতে পারেন এবং দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে পারেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মুজিববর্ষে একটি মানুষও আর গৃহহারা থাকবে না। আর ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে দেশের প্রত্যেকটি ঘরে বিদ্যুতের আলো জ¦লবে। তিনি বলেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় যা যা করণীয় তার সবই সরকার করছে। ভ্যাকসিন ক্রয়ের জন্য আমরা টাকার বরাদ্দ দিয়ে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানকে আধুনিক ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। আমাদের আশু, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে আমরা বাংলাদেশকে যেমন গড়ে তুলছি তেমনি বিজিবিকেও ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরই কেবল দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, বিজিবিকে আরও শক্তিশালী করা এবং সীমান্তের প্রতিটি জায়গায় যেন তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয় সে ব্যবস্থা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘বর্ডার গার্ড ভিশন-২০৪১’ প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ, তাঁর সরকার এখন বিজেবিকে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, বাহিনীতে হেলিকপ্টারের সঙ্গে নদীমাতৃক এই দেশের সীমান্ত প্রহরায় নৌযান সংযুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে জলে, স্থলে এবং আকাশপথে- সর্বত্রই এখন বিজিবির বিচরণ রয়েছে। ১৫ হাজার জনবলের ধাপে ধাপে অন্তর্ভুক্তি এবং প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। তাঁর সরকারই বিজিবিতে প্রথম নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারী সদস্য আমরা নিতে শুরু করেছি। পাশাপাশি, আধুনিক সরঞ্জামাদি যা যা প্রয়োজন তার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্মার্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে সীমান্তে নতুন বিওপি, বিএসপি নির্মাণসহ অত্যাধুনিক সার্ভেইলেন্স ইকুইপমেন্ট স্থাপন, এটিভি ও অত্যাধুনিক এপিসি, ভেহিক্যাল স্ক্যানার ও দ্রুতগামী জলযান সংযোজন করার মাধ্যমে বিজিবির উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পাশাপাশি, বিজিবি সদস্য ও পরিবারবর্গের চিকিৎসাসেবায় বিজিবির পাঁচটি হাসপাতালকে আরও উন্নত করা হয়েছে। বিজি হাসপাতাল, ঢাকায় একটি অত্যাধুনিক ক্যাথ ল্যাব ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) স্থাপন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বাহিনীর প্রায় ১২ হাজার সদস্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৮১৭ জন সদস্য মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাঁদের আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও বিজিবির নবীন সদস্যরা তাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করতে পারায় প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সব বিষয়ে সেরা নবীন সৈনিক হিসেবে বক্ষ নম্বর-৪৩১ রিক্রুট মো. খোকন মোল্লাকে প্রথম স্থান অর্জন করায় এবং বক্ষ নং-৬৮৭ রিক্রুট হাসিনা আক্তার বিথি শ্রেষ্ঠ ফায়ারার হওয়ায় উভয়কে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।