গোটা দেশ এখন উত্তাল ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে। প্রতিদিন গড়ে দুটি-তিনটি করে সংবাদ আসে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যার। পরিসংখ্যান বলে, এর মাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলছে। আমরা সবাই যখন সোচ্চার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে হবে, ভিক্টিম ব্লেইমিং চলবে না, আদালতে জেরার নামে ভিক্টিমকে হয়রানি করা যাবে না- ঠিক সেই সময়েই ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরু এক ভিডিওবার্তার মাধ্যমে ধর্ষণের বিচার দাবিতে অনশনরত এক ছাত্রীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে বক্তব্য দিয়েছেন।
কেন এই অপবাদ? কী দোষ সেই ছাত্রীর? ২১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী নুরসহ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ছয় নেতার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে মামলা করেছেন। জানা গেছে, ছাত্রীটিও একই সংগঠনের একজন সদস্য। অর্থাৎ, তিনি তারই দলীয় লোকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য তিনি অনশনের মতো কঠিন কর্মসূচিতেও গিয়েছেন। আমরা কেউই জানি না যে, এই অভিযোগ সত্য না মিথ্যা। কিন্তু একটি অভিযোগ এসেছে যার প্রক্রিয়ায় পুলিশ ইতিমধ্যে দুই জনকে গ্রেফতারও করেছে।
আমরা জানি নুর একজন প্রতিনিধি যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন এই একই ব্যানার থেকে। জাতীয় পর্যায়ের নানা ইস্যুতেও তিনি বক্তব্য দিয়ে থাকেন। চলমান ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সরব আছেন রাস্তায়। তাহলে তিনি কেন একজন ভিক্টিমের চরিত্র নিয়ে কথা বলছেন? নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেজন্য? সেই ছাত্রীটি যদি মিথা অভিযোগও করে থাকে তাহলেও কিন্তু নুর কেন, কেউই তাকে প্রকাশ্যে ‘দুশ্চরিত্র’ বলতে পারে না। আরেকজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মন্তব্য করার অধিকার কারোই নেই। কথা বলতে চাইলে আপনি অভিযোগ নিয়ে কথা বলবেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আপনাকে অবশ্যই যৌক্তিকভাবে আসতে হবে।
আমরা এটাও জানি যে অভিযোগকারী এর আগে বলেছিলেন যে নুর তাকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করবে বলে হুমকি দিয়েছিল। আজকে নুরের এই বক্তব্য কি সেটিকেই সমর্থন করছে না? আইন তার নিজের গতিতে চলবে। সেখানে প্রভাব খাটাতে গেলে আপনাকে ভুল পথেই যেতে হবে।
নুরের এই বক্তব্য আসলে আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া কুপুমুণ্ডুক জনগোষ্ঠীরই বক্তব্য, যারা নারীকে কেবল দুর্বলই ভাবে না, সুযোগ পেলেই নারীর চরিত্র নিয়ে মনগড়া কাহিনী গড়তে পিছ পা হয় না। নুরের বক্তব্য একজন নারীর প্রতি মারাত্মক অবমাননাকর ও আপত্তিজনক। স্বাধীন বাংলাদেশের আইনের আশ্রয় নেয়ার অধিকার সবারই আছে। সুতরাং আমি মনে করি, নুরের এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি আরেকজনের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছেন। সামাজিকভাবে হেয় করেছেন একজন নারীকে। তিনিও সমাজের প্রচলিত ধারাতেই চলতে চেয়েছেন, যেখানে যুক্তিতে না পারলে পুরুষতান্ত্রিক পেশি শক্তিকেই কায়েম করতে চায়।
আমরা আশা করি, সাবেক ভিপি নুর তার বক্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন এবং ভিক্টিমকে তার অভিযোগ প্রমাণে সকল ধরনের সহায়তা দিবেন। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাইবেন, আবার আপনি নিজেই ধর্ষকের আশ্রয়দাতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিবেন- এটা কারোই কাম্য নয়।
নুরসহ সকল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের প্রক্রিয়া চলছে। এমন একটি মুহূর্তে নুরের এমন বক্তব্য আসলে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না’ টাইপ হয়ে গেল।
লীনা পারভীন কলাম লেখক