নিউজ ডেস্ক:
এক সময় ‘ঢাকাই মসলিনের’ খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। কালান্তরেও এমন গল্প প্রচলিত আছে যে, ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত; ১০ গজ দৈর্ঘ্য, ১ গজ প্রস্থের একটি মসলিন কাপড় ছোট্ট একটা আংটির মধ্য দিয়ে আনা-নেওয়া করা যেত; ওজন ছিল মাত্র ৬-৭ তোলা।
কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই ‘ঢাকাই মসলিনের পুনর্জন্ম ঘটেছে। দেশের ৫টি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষকের ৬ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সেই মসলিনের আদলে তৈরি হয়েছে এই মসলিন শাড়ি। শুধু তাই নয়, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঐতিহ্যবাহী এই বস্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টরা গাজীপুরের কাপাশিয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে এ কাপড় তৈরির বাণিজ্যিক কারখানা নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছেন। এরই মধ্যে ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদনও পাওয়া গেছে। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারেরও নির্দেশনা দেন তিনি। তার এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণাকাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে এই কমিটিতে যুক্ত করা হয়।
কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল- তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আয়ুব আলী।
কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোনো নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। কাজেই প্রকল্পটির প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল দুটি। তুলার গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কিনা, তা নিশ্চিত করা। অন্যটি খাঁটি মসলিন কাপড় সংগ্রহ। গবেষক দলের ছয় বছরের চেষ্টা আর গবেষণা অবশেষে আলোর মুখ দেখে। তারা তৈরি করেন মসলিনের এগারোটি শাড়ি। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এক টুকরো ‘অরিজিনাল’ মসলিন কাপড় জোগাতে কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত ছুটেছে গবেষক দল। লন্ডনের ভিক্টোরিয়ান আলবার্ট মিউজিয়াম থেকে অরিজিনাল মসলিন কাপড় সংগ্রহ করা হয়। আর মসলিন বোনার সুতা যে ‘ফুটি কার্পাস’ তুলার গাছ থেকে তৈরি হয়, সেই গাছ খুঁজে বের করা হয়েছে বিচিত্র সব পন্থা অবলম্বন করে। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে এসেও এই শাড়ি তৈরিতে তাঁতিদের হাতে কাটা ৫৫৬ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়েছে। কাপড়ও বোনা হয়েছে হস্তচালিত তাঁতেই।
প্রকল্পের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেনের সঙ্গে কথা হয় আমাদের সময়ের। তিনি বলেন, মসলিন কাপড়ের নমুনা পাওয়ার পর এর সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক চারুশিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রচার করা হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনেও। অবশেষে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। এর পর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংগদু; রাজশাহী, বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৯টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের জাতটি রাবির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়। পরে এখান থেকে তুলা সংগ্রহ সেই তুলা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা কাউন্টের মাপ জানেন না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ছয়জনকে বাছাই করা হয়। এতে দুই বছর লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নকশা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত মোট ১১টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে।
অধ্যাপক মো. মনজুর হোসেন জানান, অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হবে। হয়তো আগামী মার্চের পর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হবে। আর প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়টা হবে বাণিজ্যিকভাবে ‘ঢাকাই মসলিনের’ উৎপাদন শুরু করা।