- বিনিয়োগ বাড়াতে থাকছে কর ছাড়
- কেমন বাজেট আসছে
কাওসার রহমান ॥ মহামারী করোনার মধ্যে সরকার যে কোন মূল্যে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে চায়। অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে। সংস্থান হবে মানুষের জীবিকার। সে লক্ষ্যেই আসন্ন বাজেটে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ব্যবসা সহায়ক বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতেই কমানো হচ্ছে ন্যূনতম কর হার। দেশে একটি ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কমানো হচ্ছে কর্পোরেট কর হার। করোনায় বিপর্যস্ত স্থানীয় শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে দেয়া হচ্ছে কর প্রণোদনা। কর্মসংস্থান ধরে রাখতে উৎপাদনমুখী এসব শিল্পে বিদ্যমান কর প্রণোদনা আরও তিন বছর দেয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। দেশের উদীয়মান ইলেকট্রনিক শিল্পসহ অন্য উৎপাদনমুখী শিল্পে প্রদেয় সুবিধা বহাল রাখা হচ্ছে আগামী বাজেটেও। কমানো হচ্ছে সব উৎপাদনমুখী শিল্পে কাঁচামাল আমদানির ওপর আগাম কর। এভাবে স্থানীয় শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে দেয়া হচ্ছে নানা কর প্রণোদনা।
কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের এবারের বাজেটের উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেয়া। পাশাপাশি নানা প্রণোদনা দিয়ে দেশীয় শিল্প চাঙ্গা রাখা। সে লক্ষ্যেই সরকার আগামী বাজেটে দেশীয় শিল্পের বিকাশের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে যাচ্ছে।
করোনা মহামারীর মধ্যে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই সরকার ব্যবসা সহায়ক বাজেট প্রণয়ন করছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের সার্বিক পরিবেশ উন্নতি করা। এ লক্ষ্যেই আগামী বাজেটে বিশেষভাবে কমানো হচ্ছে কর্পোরেট কর হার। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এখনও অনেক বেশি। চলতি ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম স্থানে নামিয়ে আনার ঘোষণা করেছে সরকার। গত বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দু’ধাপ অগ্রগতি হয়ে ১৬৮তম অবস্থানে পৌঁছেছে। ফলে ৯৯ অবস্থানে নামাতে হলে বাংলাদেশকে অনেক সংস্কার করতে হবে। সে লক্ষ্যেই এগুচ্ছে সরকার। এই সূচকে উন্নতির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে কর্পোরেট কর। বাংলাদেশে এই কর্পোরেট কর প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখনও অনেক বেশি। এ জন্যই সরকার আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যাতে ধাপে ধাপে কমিয়ে প্রতিযোগী দেশগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে পাঁচটি স্তরে কর্পোরেট কর আদায় করা হয়। সর্বোচ্চ কর হার ৪৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ। আগামী বাজেটে দুটি স্তরে কর্পোরেট কর হার কমছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে নন-লিস্টেড কোম্পানি যা শেয়ার বাজারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অপরটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি।
নন-লিস্টেড কোম্পানির কর্পোরেট কর হার বর্তমানে সাড়ে ৩২ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে এই হার কমিয়ে ৩০ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে। অপরদিকে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্পোরেট কর হার বর্তমানে সাড়ে ২৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে তা কমিয়ে করা হচ্ছে সাড়ে ২২ শতাংশ। অর্থাৎ উভয়ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর হার আড়াই শতাংশ কমানো হচ্ছে নতুন বাজেটে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কর্পোরেট কর কমানো হলে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ কমবে এবং তারা পুনরায় বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হবেন। প্রতিবেশীসহ অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কর্পোরেট কর হার বেশি থাকার কারণে ব্যবসায় খরচ বেশি হচ্ছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তারাও দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছেন বাংলাদেশে কর্পোরেট কর হার অনেক বেশি। তাদের যুক্তি কর হার কমালে কোম্পানির মুনাফা বেশি থাকবে। ফলে মুনাফার কিছু অংশ পুনরায় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধির গতি বাড়বে।
ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে কর্পোরেট কর হার কম এবং কর কাঠামো সহজ। ভারতে কর্পোরেট কর হার দুটি। বড় কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ এবং স্থানীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে কর্পোরেট কর হার যথাক্রমে ২৮ ও ৩০ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে একটিমাত্র কর্পোরেট কর হার এবং তা মাত্র ১৩ শতাংশ।
এটা বিবেচনা করেই সরকার এবারের বাজেটে ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধা দিতে যাচ্ছে। এনবিআরের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে করোনাকালীন বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে আগামীতে বিনিয়োগবান্ধব বাজেটে করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের উদীয়মান শিল্প হচ্ছে ইলেকট্রনিক শিল্প। এ শিল্প বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও পণ্য রফতানি করছে। ফলে এ শিল্পকে সরকার আরও প্রণোদনা দিয়ে চাঙ্গা রাখতে চায়। বর্তমানে
ফ্রিজ, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনসহ এসব পণ্য দেশীয় ইলেকট্রনিক্স শিল্প মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৩০ জুন ২০২১ সালে। এসব খাতে উৎপাদিত পণ্যের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় না। অর্থাৎ উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে।
আগামী বাজেটেও এ সুবিধা আরও তিন বছরের জন্য বহাল রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনমুখী এসব শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।
এছাড়া, আসন্ন বাজেটে ইলেকট্রনিক্স খাতের আরও বেশ কিছু পণ্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রাইস কুকার, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ব্লেন্ডার মেশিন ইত্যাদি।
এসব পণ্য উৎপাদন করলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে না। আবার যারা এসব কারখানা স্থানীয়ভাবে স্থাপন করবেন, তাদের জন্য ১০ শতাংশ কর অবকাশ সুবিধা (ট্যাক্স হলিডে) দেয়ার প্রস্তাব থাকছে আগামী বাজেটে।
বর্তমানে যে নতুন ভ্যাট আইন চালু আছে, তাতে আগাম কর আদায়ের নিয়ম রয়েছে। একে এ্যাডভান্সড ট্রেড ভ্যাটও বলা হয়। আমদানি পর্যায়ে প্রত্যেক পণ্যের বিপরীতে ৫ শতাংশ হারে এই কর আহরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে মাসিক ভ্যাট রিটার্ন জমার সময় আগাম কর ফেরত দেয়ার কথা উল্লেখ আছে আইনে। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, আগাম কর ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে এটি প্রত্যাহারের দাবি ওঠে এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী মহল থেকে। কিন্তু তা না করে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর আগাম কর ৫ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করে।