অধ্যাপক শেখর কুমার সান্যালঃ
নজরুলের মধ্যে কি জীবনে কি সাহিত্যে পরস্পর বিরোধী ভাবধারার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল। সত্যিকার প্রতিভা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। নজরুলের জীবন গতানুগতিক পথ ধরে চলে নি। নজরুলের জীবনে ও সাহিত্যে দ্রোহ ও প্রেম ছাড়াও এক ধরণের উচ্ছ্বাস, বেদনাবোধ, মরমীয়া মননশীলতা, বিরহকাতরতা, বোহেমিয়ানপনা, বাঁধনছাড়ার প্রবণতা একই সাথে লক্ষ্যণীয়। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের চতুর্থ পর্বে ‘গহর’ নামে একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র আছে। গহরের ভাবালুতার মধ্যে নজরুলের ছায়া যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নজরুলের গদ্য রচনা খুব কম আলোচিত বিষয়। নজরুলের প্রথম উপন্যাস ‘বাঁধনহারা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রকৃত পত্রপন্যাস। উপন্যাসের নায়ক নূরুল হুদা কখনোই কোনো বাঁধনে আটকা পড়তে চায় না। ঠিক যেন নজরুল নিজেই। রবীন্দ্রনাথের ‘অতিথি’ গল্পের মূল চরিত্র ‘তারাপদ’ও যেন একই ছাঁচে ঢালা।
নজরুলের মতো বৈচিত্র্যময় জীবন বাংলা সাহিত্যে একমাত্র মধুসূদন ছাড়া আর কারো ছিল না। নজরুল ও মধুসূদনের মানসিকতার একটি ক্ষেত্রে ছিল অদ্ভুত মিল। দুজনেরই বাঙালিত্ব ছিল বিস্ময়কর। নজরুলের বাঙালিত্ব সম্বন্ধে তাঁর কারাজীবনের অন্তরঙ্গ সুহৃদ নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী মন্তব্য করেছিলেন “দিনের পর দিন একসঙ্গে বাস করে একথা ক্ষণকালের জন্যও মনে হয় নি যে কাজী বাঙালি ছাড়া আর কিছু। বাংলার সবই ছিল কাজীর আপন। তাই বাংলার প্রাচীন কাব্য ও সাহিত্য তার রূপ ও বৈভব নিয়ে ধরা দিয়েছিল কাজীর কাছে। বিদ্রোহ আর প্রেমের সমন্বয়ে কাজী বাঙালি কবি, কাজী বাঙালি মরমী প্রেমিক, কাজী বিদ্রোহী বাংলার মুখর বন্দনা। কাজী নিখুঁত বাঙালি। ভাষার ঐশ্বর্যে বাঙালি। দারিদ্র্যে বাঙালি। ভাবের বিলাসিতায় বাঙালি। ধর্মে বাঙালি। আর বাঙালি সব হারানোর সাধনায়।”
নজরুল সার্থক ভাবে বাংলাদেশ আর বাংলা ভাষার কবি। তাঁর সৃষ্টিতে বাংলাদেশ এক অখণ্ড ও অবিভাজ্য মহিমায় বিধৃত। তাই নজরুল এপার আর ওপার দুই বাংলারই কবি। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায়-
“ভুল হ’য়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছু ভাগ হ’য়ে গেছে
ভাগ হয় নিকো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।”
নজরুল কারো কাছে নতি স্বীকার করেন নি কোনো দিন। এমনকি মৃত্যুর কাছেও নয়। দৈহিক জীবনের অবসান হলেও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) লিখেছিলেন –
“কবি নজরুল ইসলাম
এক্ষুনি শুনিলাম
তুমি নাকি মারা গেছ!
এটা তো মিথ্যা খবর –
তুমি অবিনশ্বর,
তুমি বিদ্রোহী বীর,
মৃত্যুর কাছে তুমি কি নোয়াবে শির!”
নজরুলের বিদ্রোহ কেবল মাত্র বিদেশী শাসকদের বিরূদ্ধে ছিল না। সমাজের অন্যায় অবিচারের বিরূদ্ধে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরূদ্ধে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরূদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল সমভাবে সোচ্চার। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় একজন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি তাঁর উপন্যাসে হিন্দু সমাজের কুসংস্কারের বিরূদ্ধে লিখেছেন, মুসলমান সমাজের কথা কেন লেখেন নাই। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন হয়ত কোনো মুসলমান লেখক সে দায়িত্ব পালন করবেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ ‘লালসালু’ সহ তার অন্যান্য লেখায় সে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরো অনেকেই করছেন। নজরুল প্রথম লেখক যিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়ামির বিরূদ্ধে কলম ধরেছেন। সেজন্য তিনি যেমন উভয় সম্প্রদায়ের কাছে প্রশস্তি পেয়েছেন তেমনি নিন্দাও শুনতে হয়েছে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছ থেকে। এক সময় তিনি অভিমান করে লিখেছিলেন-
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিব না।
কোলাহল ক’রি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।”
‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন “যুগের না হোক, হুজুগের কবি বটিতো রে দাদা”। তিনি হুজুগের নয়, যুগের কবিই ছিলেন। শুধু তাঁর যুগের নয়, সব যুগের। যুগোত্তীর্ণ কবি তিনি। আমাদের সব সংগ্রামে, সব প্রতিবাদে আজও নজরুল আমাদের সাথী। আমরা এখন ‘মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে, সংগীতশূন্য বিষণ্ণ মনে’ এক অস্থির সময় পার করে চলেছি। আজও ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে’ ধ্বনিত হচ্ছে। ‘অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ’কে ‘ভীম রণ-ভূমে’ রণিত হতে দেখছি। আজও ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। নজরুলের বড়ো বেশি প্রয়োজন এখন এই সময়ে। ‘পঁচিশে বৈশাখের প্রতি’ কবিতায় সুকান্ত লিখেছিলেন-
“আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের”।
ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ইংলন্ডের দুরবস্থা দেখে ‘London, 1802’ নামে একটি সনেট শুরু করেছিলেন এই ভাবে-
“Milton! thou shouldst be living at this hour:
England hath need of thee: she is a fen
Of stagnant waters.”
ছাত্রজীবনে কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য আমি কবিতাটির একটি বাংলা অনুবাদ করেছিলাম। সামান্য পরিবর্তন করে সুকান্ত ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করছে ‘নজরুল, তুমি আজ জাগ্রত হও আমাদের চেতনায় –
“দীনতা ও হীনতার টুটিতে বন্ধন,
মানবতা-মহাভাব জাগরণ তরে
উদ্বুদ্ধ প্রেরণা তব হোক প্রতি ঘরে,
হে মহান ‘নজরুল’ হও তার সাথী”।